
ছবি: সংগৃহীত
গোপালগঞ্জে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক উত্তেজনা, সহিংসতা ও প্রাণঘাতী ঘটনার পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে ১৪৪ ধারা এবং কারফিউ জারি করা হয়েছিল, তা অবশেষে প্রত্যাহার করা হয়েছে। রোববার (২০ জুলাই) সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মিডিয়া সেলে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ওইদিন রাত ৮টার পর থেকে জেলায় আর কোনো ধরনের কারফিউ বা ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকবে না।
এই ঘোষণার মাধ্যমে কয়েক দিন ধরে থমথমে পরিস্থিতিতে থাকা গোপালগঞ্জে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার আশা করছেন স্থানীয়রা। তবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে প্রশাসন।
গোপালগঞ্জের সাম্প্রতিক এই সংকটের সূত্রপাত ঘটে গত বুধবার (১৬ জুলাই)। ওইদিন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঘোষিত “জুলাই পথযাত্রা” ও জেলা সমাবেশ চলাকালে হামলার ঘটনা ঘটে। অভিযোগ অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এনসিপির শোভাযাত্রা ও সমাবেশে হামলা চালায়।
সকাল থেকে শুরু হওয়া এই সহিংসতা দুপুর গড়াতে গড়াতে রক্তাক্ত রূপ নেয়। একাধিক স্থানে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে এবং দু’পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলায় কয়েকজন নিহত হন, আহত হন অনেকে। জেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক, বন্ধ হয়ে যায় যানবাহন চলাচল, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৬ জুলাই রাত ৮টা থেকে পরদিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে প্রশাসন। তবে পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় তা একাধিকবার বাড়ানো হয়।
১৭ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১৮ জুলাই সকাল ১১টা পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় কারফিউ বাড়ানো হয়।
১৮ জুলাই দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আবারও কারফিউ জারি করা হয়, যা ১৯ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত বহাল থাকে।
১৯ জুলাই সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সাময়িকভাবে কারফিউ শিথিল করা হয়, কিন্তু ওই রাত ৮টা থেকে ২০ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত ফের কারফিউ জারি করা হয়।
রোববার সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত জেলায় ১৪৪ ধারা বলবৎ রাখা হয়।
প্রশাসনের এসব পদক্ষেপের ফলে জনজীবন এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়ে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হননি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এমন আতঙ্কিত পরিবেশ গত কয়েক বছরে আর দেখেননি তারা।
রোববার সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষ থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে রাত ৮টা থেকে ১৪৪ ধারা ও কারফিউ আর বলবৎ থাকবে না। তবে, প্রশাসনের তরফ থেকে পরিস্থিতি নিয়মিত মনিটর করা হবে এবং প্রয়োজনে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। একইসাথে এই সহিংসতায় জড়িতদের খুঁজে বের করতে এবং আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এদিকে, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বিএনপি স্থানীয় নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তারের অভিযোগ তুলেছে। দলটির দাবি, প্রশাসনের এই পদক্ষেপ নিছক রাজনৈতিক হয়রানির অংশ এবং এতে সাধারণ মানুষ ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষ এই সহিংসতা ও প্রশাসনিক বিধিনিষেধে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকের ব্যবসা, জীবনযাপন ও চলাফেরা সীমিত হয়ে পড়ে। কারফিউ ও ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারকে তাঁরা স্বস্তির নিঃশ্বাস হিসেবে দেখছেন, তবে একইসঙ্গে দাবি জানিয়েছেন, যেন ভবিষ্যতে রাজনৈতিক মতপার্থক্য কখনো সহিংস রূপ না নেয় এবং সকল পক্ষ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে।
গোপালগঞ্জের সহিংস ঘটনার পরবর্তীতে প্রশাসনের কড়া পদক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও এই ঘটনার প্রেক্ষাপট এবং এর দায় নির্ধারণ এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করলেই শুধু এই ঘটনার প্রকৃত সমাধান সম্ভব।
দেশজুড়ে যেন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকে—এটাই এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ