
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) 'জুলাই পদযাত্রা' কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় প্রাণহানি ও ব্যাপক আতঙ্কের পর পুরো জেলায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসন শুরুতে তিন ঘণ্টার জন্য বিরতি দিয়ে কারফিউ জারি করলেও পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তা কার্যকর রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর যৌথ টহল চলছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ২০ জনকে আটক করা হয়েছে। সহিংসতায় নিহত চারজনের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই রাতেই দাফন ও সৎকার করা হয়েছে।
১৬ জুলাই সকাল থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল গোপালগঞ্জে। এনসিপির ঘোষিত ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল সতর্ক অবস্থানে। গোপালগঞ্জ শহরের উন্মুক্ত মঞ্চে সকাল ১১টায় অনুষ্ঠিতব্য জনসমাবেশে অংশ নিতে বিভিন্ন জেলা থেকে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা রওনা দেন। তবে তার আগে থেকেই শহরের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় প্রতিবন্ধকতা।
সকাল ৯টার দিকে উলপুর এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা ও পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে এক পুলিশ পরিদর্শকসহ তিন পুলিশ সদস্য আহত হন।
পরে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোপালগঞ্জ সদর, কোটালীপাড়া এবং অন্যান্য এলাকায় আওয়ামী লীগের সমর্থকদের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একাধিক দল সড়ক অবরোধ করে। কংশুর বাসস্ট্যান্ড, অবদার হাট, কাঠি বাজার, সাতপাড়া, লঞ্চঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় গাছ ফেলে, কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যখন দুপুর দেড়টার দিকে উন্মুক্ত মঞ্চে এনসিপির নেতারা পৌঁছান এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে হামলা হয়।
দুপুর ২টার দিকে সমাবেশ শুরু হলেও মিনিট দশেকের মধ্যে ছাত্রলীগের একটি সশস্ত্র দল ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সমাবেশস্থলে হামলা চালায়। উপস্থিত জনতার ওপর চালানো হয় ঢাল, রড ও দেশীয় অস্ত্রের আক্রমণ। চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হয়। আহত হন বহু নেতা-কর্মী। প্রায় একই সময়ে শহরের সাতপাড়া এলাকায় মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং রাস্তায় গাছ ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা।
সভা শেষ করে বিকাল পৌনে ৩টায় এনসিপি নেতারা যখন গাড়িবহর নিয়ে মাদারীপুরের উদ্দেশে রওনা দেন, তখন লঞ্চঘাট এলাকায় আবারও তারা হামলার মুখে পড়েন। পুলিশের পাশাপাশি সেনা সদস্যরাও হামলার লক্ষ্যবস্তু হন। পুলিশ-সেনাবাহিনী চেষ্টা করে উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে, কিন্তু এতে আরও বাড়ে সংঘর্ষের মাত্রা।
এই সহিংসতায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন দীপ্ত সাহা (৩০), রমজান কাজী (১৭), সোহেল রানা (৩৫) ও ইমন (বয়স অজ্ঞাত)। আরও অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন, যাদের মধ্যে আছেন সাংবাদিক ও পুলিশ সদস্যরাও।
নিহত চারজনের কারও লাশের ময়নাতদন্ত না করে রাতেই লাশ জেলা হাসপাতাল থেকে জোরপূর্বক নিয়ে গিয়ে দাফন ও সৎকার করা হয়েছে। এ ঘটনায় সার্বিক সহিংসতা ও মৃত্যুর পেছনের কারণ অনুসন্ধানে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণিকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। বাকি দুই সদস্য জনপ্রশাসন এবং আইন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা। তাদেরকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে।
গোপালগঞ্জ সফর করেছেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং সেনা কমান্ডাররা। সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক জানান, “এই ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি দায়িত্বে কোনো গাফিলতি করে থাকে, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন, “সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি সব বাহিনী বর্তমানে মাঠে রয়েছে। জনগণের নিরাপত্তার জন্য যা যা করণীয়, সবকিছুই করা হচ্ছে।”
গোপালগঞ্জে ১৫০৭ জন অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য, সেনাবাহিনী এবং বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা থেকে পুরো জেলায় কারফিউ জারি করা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা পর্যন্ত এই কারফিউ কার্যকর থাকবে। শুধুমাত্র বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত জনগণের চলাফেরার জন্য কারফিউ শিথিল থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ পুলিশ গতকাল বিকেলে তাদের অফিশিয়াল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বিস্তারিতভাবে ১১টি পয়েন্টে বর্ণনা করা হয়েছে পুরো সহিংসতার সময়রেখা।
এই প্রতিবেদনে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন শাখা ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ভূমিকা, সড়ক অবরোধ, ককটেল বিস্ফোরণ, অস্ত্র নিয়ে হামলা এবং পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাগুলোর বিস্তারিত দেওয়া হয়েছে।
যদিও প্রশাসন বলছে, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে, তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক রয়ে গেছে। দোকানপাট বন্ধ, যানবাহন চলাচল স্তব্ধ, মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল, চারদিকে থমথমে অবস্থা।
এই ঘটনার পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে এখনও উৎকণ্ঠায় গোপালগঞ্জবাসী।
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে ঘিরে সহিংসতার এই ঘটনা জাতীয় রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। কারফিউ, সেনা মোতায়েন এবং মৃত্যু—এই সবকিছু মিলে যেন গোপালগঞ্জ পরিণত হয়েছে এক উদ্বেগের নাম। এখন দেখার বিষয়, তদন্ত কী ফলাফল দেয় এবং আদৌ কি দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়? দেশবাসী সেই উত্তরই এখন খুঁজছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ