
ছবি: সংগৃহীত
দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ৯৬টি দেশি সংস্থার নিবন্ধন চূড়ান্তভাবে বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে নিশ্চিত করেছে ইসির জনসংযোগ শাখা। ইসি সচিবালয় সূত্র বলছে, নতুন করে প্রণীত পর্যবেক্ষণ নীতিমালার ভিত্তিতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন তথা ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কাঠামো গঠনের অংশ হিসেবে বিবেচিত।
ইসি জানায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মোট ৯৬টি দেশি সংস্থাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। এসব সংস্থা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এবং ভোট পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত ছিল। তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন নতুন নীতিমালা গ্রহণ করেছে, যেখানে পূর্বের এসব সংস্থার সঙ্গে নতুন করে নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। ফলে পুরনো সংস্থাগুলোর নিবন্ধন চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হয়েছে।
ইসির সহকারী জনসংযোগ পরিচালক মো. আশাদুল হক গণমাধ্যমকে জানান, "নতুন পর্যবেক্ষণ নীতিমালায় আগের তুলনায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে।" এর মধ্যে অন্যতম হলো— পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোকে নতুন করে আবেদন করতে হবে। নতুন নীতিমালার আওতায় প্রতিটি নিবন্ধন পাঁচ বছরের জন্য প্রযোজ্য হবে। একটি সংস্থা ভোটের আগে ও পরে মোট তিন দিন পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে পারবে। সংস্থার পর্যবেক্ষকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বয়সের শর্ত আরও কঠোর করা হতে পারে।
বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দেশি সংস্থার নিবন্ধন ও অংশগ্রহণ নতুন নয়। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রথমবারের মতো ইসি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশি পর্যবেক্ষকদের নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়। সে সময় ১৩৮টি সংস্থা নিবন্ধন পায় এবং এক লাখ ৫৯ হাজার ১১৩ জন পর্যবেক্ষক মাঠে থাকেন।
এরপর ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় ৩৫টি সংস্থা, যাদের ৮ হাজার ৮৭৪ জন পর্যবেক্ষক ছিলেন মাঠে। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ১১৮টি নিবন্ধিত সংস্থার মধ্যে ৮১টি সংস্থা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়, যারা ২৫ হাজার ৯০০ জন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, মোট ৯৬টি সংস্থা নিবন্ধিত থাকলেও প্রায় ৮০টি সংস্থা মাঠে সক্রিয় ছিল এবং তাদের মাধ্যমে ২০ হাজার ২৫৬ জন পর্যবেক্ষক নির্বাচনের দিন কাজ করেন।
ইসির এই পদক্ষেপ শুধু প্রশাসনিক নয়, বরং রাজনৈতিক অর্থেও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সাবেক সরকার আমলে নিবন্ধন পাওয়া সংস্থাগুলোর কিছু কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সংস্থা। অনেক পর্যবেক্ষক সংস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। এ প্রেক্ষিতে নতুন নির্বাচন কমিশন, যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন, দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই এই সংস্থাগুলোর নিবন্ধন পর্যালোচনার উদ্যোগ নেন।
নতুন কমিশন চাইছে, নির্বাচনের পরিবেশ, বিশ্বাসযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হোক। এজন্য পুরনো সংস্থাগুলোর নিবন্ধন বাতিল করে নতুনভাবে আগ্রহী ও যোগ্য সংস্থাগুলোর আবেদন গ্রহণ করে পূর্ণাঙ্গ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে পাঁচ বছরের জন্য নিবন্ধন দেওয়া হবে।
ইসি জানিয়েছে, অচিরেই একটি নতুন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আবেদন আহ্বান করা হবে। তাতে আগ্রহী সংস্থাগুলোকে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে আবেদন করতে হবে এবং ইসির যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদিত সংস্থাগুলোই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার লক্ষ্যে ইসির এ পদক্ষেপ ইতিবাচক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে তারা মনে করেন, আগামীতে যারা নিবন্ধন পাবে, তাদের দক্ষতা, নিরপেক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে, যেন কোনোভাবেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ একটি বিতর্কিত বা পক্ষপাতদুষ্ট প্রক্রিয়ায় পরিণত না হয়।
নতুন নীতিমালার আওতায় বাস্তবায়িত নিবন্ধন কার্যক্রম সফল হলে তা ভবিষ্যতের সব ধরনের নির্বাচনকে আরও বিশ্বস্ত ও গ্রহণযোগ্য করার পথে একটি মাইলফলক হিসেবে গণ্য হবে—এমনটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ