
ছবি: সংগৃহীত
মৌলিক কাঠামোর সংস্কারের লক্ষ্যে গঠনকৃত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দেশের রাজনীতিতে এক বড় পরিবর্তনের প্রত্যাশায় কাজ শুরু করলেও, দীর্ঘ সময় পার হলেও এখনো ৯টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। ফলে ‘জুলাই সনদ’ বা জাতীয় ঐকমত্য সনদ তৈরির লক্ষ্যে বৈঠক-আলোচনা দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং জটিলতাও বাড়ছে।
এখনও অনিশ্চিত ৯ ইস্যু কী?
১. সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত কমিটি (আগে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি’ নামে পরিচিত)
২. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কাঠামো — বিশেষ করে উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য মনোনয়ন ও নির্বাচনের পদ্ধতি এবং এখতিয়ার
৩. সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সরাসরি নির্বাচনের পদ্ধতি
৪. রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি
৫. সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া
৬. রাষ্ট্রের মূলনীতি পুনর্বিন্যাস
৭. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নির্দিষ্টকরণ
৮. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো ও গঠন প্রক্রিয়া
৯. সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়া
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মার্চ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকে বসে সংস্কারের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করছে। যদিও কিছু বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, তবে কাঠামোগত ও মূল নীতিমালা নিয়ে এখনো দ্বিমত বিদ্যমান। বৃহস্পতিবার কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতে কাজের অগ্রগতি তুলে ধরেন এবং প্রধান উপদেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
বিগত ১১ মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে মৌলিক সংস্কারের চূড়ান্ত রূপরেখা গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ এবং অবস্থানকাঠামোর জটিলতায় ঐকমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছে। ৯টি প্রস্তাব এখনো unresolved থাকার ফলে আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কাঠামো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন, সংবিধান সংশোধন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, সংরক্ষিত আসন বৃদ্ধি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নির্দিষ্টকরণ এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়া।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, “দলগুলোকে খানিকটা ছাড় দিয়ে হলেও একটি যৌক্তিক জায়গায় আসা জরুরি। এটা ‘জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের শহীদদের প্রতি দায়িত্ব পালনের একটি পদক্ষেপ।” তিনি আশা প্রকাশ করেন আগামী সপ্তাহে একটি যুক্তিসঙ্গত অবস্থানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
অন্যদিকে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিধান, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ ও উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত স্থাপনের মতো সাতটি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ইতোমধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবনায় দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের ব্যাপারে একমত থাকলেও প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিভক্তি বিদ্যমান। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির মতো দলগুলো সংবিধান সংস্কার এবং নির্বাচনী পদ্ধতি সংক্রান্ত প্রস্তাবনায় ভিন্নমত পোষণ করছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ মন্তব্য করেন, “সব বিষয়ে একমত হতে হবে এমন দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। রাজনীতিতে মতভিন্নতা স্বাভাবিক এবং ঐকমত্য কমিশনকে সবার জন্য একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো দরকার।”
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, “অনেক বিষয়ে ইতোমধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো এবং পিআর পদ্ধতির নির্বাচন নিয়ে অনৈক্য রয়েছে। দলীয় স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে কাজ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, “সরকার দ্রুত কাজ শেষ করতে চাইলে দলগুলোর সঙ্গে ঘনঘন বৈঠক করতে হবে। সব দল সমান নয়, কিছু দলের গুরুত্ব বেশি। সরকারের উচিত প্রধান দলগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া।”
গত কয়েক সপ্তাহে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণাসহ রাজনীতির উত্তাপ বাড়ার ফলে দলগুলোর মধ্যকার আক্রমণাত্মক বক্তব্য ও দ্বিমতও বেড়েছে। এর ফলে ঐকমত্যের প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সৈয়দ এহসানুল হুদা, ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক, মন্তব্য করেন, “সব বিষয়ে শতভাগ ঐকমত্যের আশা রাখা উচিত নয়। তবে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনায় এনে নির্বাচন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা হচ্ছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আগামী সপ্তাহ থেকে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক চালিয়ে বাকি অনৈক্যপূর্ণ বিষয়গুলোর সমাধান খুঁজবে। বিশেষ করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোর বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে। দলগুলো তাদের প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করে ঐক্যের জন্য আরও নমনীয়তা প্রদর্শন করলে ‘জুলাই সনদ’ বা জাতীয় ঐকমত্য সনদ সময়মতো ঘোষণা করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দেশের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মৌলিক কাঠামোর সংস্কারে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজ বেশ গুরুত্বপূর্ন। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত ও অনৈক্য এই প্রক্রিয়াকে জটিল ও ধীরগতির করে তুলেছে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতে, সরকার ও কমিশনকে দ্রুতগতিতে দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় বাড়িয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা চালাতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের আলোকে গঠিত এই ঐকমত্যই হবে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির মূলে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ