
ছবি: সংগৃহীত
টানা ১৩ বছর ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না—এ এক গভীর কাঠামোগত সমস্যার ইঙ্গিত বহন করছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও এই ধারার কোনো পরিবর্তন হয়নি। দেশের সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়ক প্রতিষ্ঠান এনবিআর এবারও লক্ষ্যমাত্রার ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কর আদায়ের বর্তমান কাঠামো ও প্রয়োগযোগ্য বাস্তবতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মোট কর আদায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। অথচ সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা।
এর আগে অর্থবছরের শুরুতে সরকার এনবিআরের জন্য রাজস্ব আদায়ের মূল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। তবে বছরজুড়ে আদায় পরিস্থিতি মন্থর হওয়ায় তা কমিয়ে আনা হয় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকায়, তাতেও কাঙ্ক্ষিত আদায় হয়নি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দুই দশমিক ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়াটা বড় এক প্রশাসনিক ব্যর্থতা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য এনবিআরের ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। এবারে এনবিআরকে কর আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে তা আরও উচ্চাভিলাষী—৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি এবং আগের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৪ শতাংশ বেশি।
গত পাঁচ বছর ধরে রাজস্ব আদায়ের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি যেখানে গড়ে ১১ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেখানে ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কতটা বাস্তবসম্মত—তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “বর্তমানে যে ধরনের কর ব্যবস্থা প্রস্তাব করা হচ্ছে, তাতে বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা বাস্তবিকভাবে অর্জন করা সম্ভব নয়।”
তিনি মনে করেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মূল চ্যালেঞ্জ হলো কর ফাঁকি এবং কর পরিহার। একে দমন করতে না পারলে নতুন কোনো কাঠামো কার্যকর হবে না। তার মতে, ‘কর ব্যবস্থায় ডিজিটাল অটোমেশন ও কঠোর নজরদারি ছাড়া লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয়।’
সিপিডির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কর ফাঁকি ও কর এড়ানোর কারণে প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই ছিল করপোরেট কর ফাঁকি।
তৌফিকুল ইসলাম খান মনে করেন, বর্তমান রাজস্ব কাঠামো প্রায় পুরোটাই সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের কাঠামোর মতোই। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন হলেও এনবিআরের কাঠামোগত নীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো সংস্কার হয়নি।
তিনি বলেন, “এই কাঠামো রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কিংবা ব্যয়ের পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি বাস্তবতাবিবর্জিত এবং আর্থিক স্থিতিশীলতার পক্ষে হুমকি।”
তার মতে, অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই সরকারের উচিত সংশোধিত বাজেট ঘোষণা করা এবং রাজস্ব খাতে একটি বাস্তবসম্মত সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করা।
তিনি সতর্ক করে বলেন, বাজেট ঘাটতি সাময়িকভাবে সামাল দিতে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) খাতে বরাদ্দ কমানোর কৌশল নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়।
উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে সরকার এডিপির মোট বরাদ্দের মাত্র ৪৯ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি-র তথ্য অনুযায়ী, এটি একটি গভীর কর্মদক্ষতার ঘাটতির পরিচায়ক।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে বাংলাদেশকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৪ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে এই লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করতে পারেনি এনবিআর, ফলে আইএমএফ-এর শর্তপূরণেও ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ব্যর্থতা শুধু রাজস্ব ঘাটতির সমস্যা নয়, বরং বৈদেশিক সহায়তা ও ঋণ নির্ভরতার ভবিষ্যতকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।
টানা ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে এনবিআরের প্রতি জনগণের আস্থা যেমন ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তেমনি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। সরকারের উচিত শিগগিরই কর কাঠামোতে রূপান্তরমূলক সংস্কার আনা, অটোমেশন জোরদার করা এবং কর ফাঁকির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা। নইলে রাজস্ব ঘাটতির এই স্থায়ী অসামঞ্জস্য ভবিষ্যতে আরও বড় আর্থিক সংকট ডেকে আনবে।
বাংলাবার্তা/এসজে