
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান অভ্যন্তরীণ সংকট ও উত্তেজনার মধ্যে বদলির আদেশ ছিঁড়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানানোয় আরও সাত কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সরকার। এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র ও জারি করা অফিস আদেশ অনুযায়ী, এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে 'আচরণবিধি লঙ্ঘন এবং শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজের' অভিযোগ আনা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব (প্রশাসন) উম্মে আয়মান কাশমীর সই করা আদেশে এসব বরখাস্তের তথ্য জানানো হয়। আদেশে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা চলমান প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অসদাচরণ করেছেন এবং সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন।
সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া সাতজন হলেন—
কর অঞ্চল-২ এর কর পরিদর্শক লোকমান হোসেন
কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট ঢাকার কর পরিদর্শক নাজমুল হাসান
একই ইউনিটের কর পরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল মামুন
সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ছালেহা খাতুন সাথী
সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা রৌশনারা আক্তার
কর অঞ্চল-১৪ এর প্রধান সহকারী বিএম সবুজ
কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা দক্ষিণের সিপাই সালেক খান
এই সাতজনকে বরখাস্ত করার আগে একই দিন সকালে ও রাতে দুই দফায় আরও ১৪ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে একই অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ফলে বদলি আদেশ ছিঁড়ে প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার দায়ে একদিনে মোট ২১ জন এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বহিষ্কার করা হলো।
২০২৪ সালের ২২ জুন হঠাৎ করে এনবিআর আয়কর অনুবিভাগের পাঁচজন উপ-কর কমিশনারকে ‘তাৎক্ষণিক বদলি’ করে একটি আদেশ জারি করে। এই বদলিকে এনবিআরের ভেতরে চলমান সংস্কারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘প্রতিহিংসা ও নিপীড়নমূলক’ বলে বিবেচনা করা হয়। ২৪ জুন, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রকাশ্যে সেই আদেশ ছিঁড়ে ফেলেন। এ সময় তারা ‘এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমানের অপসারণ চাই’—এমন স্লোগানও দেন।
বিশেষ করে কর প্রশাসনের বদলির আদেশে আলোচিত ছিলেন কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা। উপ-কর কমিশনার শাহ মোহাম্মদ ফজলে এলাহীকে আয়কর গোয়েন্দা থেকে ময়মনসিংহ কর অঞ্চলে, মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলামকে ঢাকার কর অঞ্চল-১৬ থেকে খুলনায়, এবং মো. আব্দুল্লাহ ইউসুফকে বোর্ড থেকে সরিয়ে বগুড়ায় বদলি করা হয়। একই সঙ্গে উপ-কর কমিশনার ইমাম তৌহিদ হাসান শাকিল এবং নুসরাত জাহান শমীকে যথাক্রমে কুমিল্লা ও রংপুরে বদলি করা হয়।
এই বদলির পর থেকেই এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অভিযোগ করতে থাকেন, বর্তমান চেয়ারম্যান নিজের অবস্থান রক্ষার জন্য রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কর্মকর্তাদের ‘শাস্তিমূলক’ বদলি করছেন। ফলে এনবিআর অঙ্গনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলন তীব্রতর হয়।
পরবর্তী সময়ে ২৯ জুন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলন স্থগিত করেন। তবে ততদিনে সরকার এনবিআরের চার শীর্ষ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় এবং ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরখাস্তের বিষয়ে এনবিআরের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। একজন কর্মকর্তা বলেন, “সরকারি আদেশ প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা নজিরবিহীন এবং প্রশাসনিক শৃঙ্খলার জন্য হুমকি স্বরূপ। এতে কর প্রশাসনের মর্যাদা ও কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।”
তবে আন্দোলনকারীদের বক্তব্য ভিন্ন। তাঁদের মতে, এই বরখাস্ত এবং বদলিগুলো 'ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে আন্দোলন দমন করার অপচেষ্টা'। একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “যারা পরিবর্তনের কথা বলেন, তাদের মুখ বন্ধ করতে এসব অপসারণ ও বরখাস্তের পথ বেছে নেওয়া হয়েছে।”
এই সাময়িক বরখাস্ত ও বদলি প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে এনবিআরের ভেতরে এক ধরনের চরম অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রশাসন এখন যেকোনো ‘প্রতিবাদী কণ্ঠ’কে কঠোর শাস্তি দিতে চাইছে। ফলে এনবিআরের কার্যক্রমেও ধীরগতির প্রভাব পড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা ও আস্থার পরিবেশ না থাকলে দীর্ঘমেয়াদে কর আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে এনবিআরের মধ্যে সাংগঠনিক স্থিতি ফিরিয়ে আনতে সরকারকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে।
এনবিআরের ভেতরে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও প্রতিরোধের দ্বন্দ্ব ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব যদি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে সমাধান না করা হয়, তাহলে তা কেবল রাজস্ব সংগ্রহে নয়, সামগ্রিক অর্থনীতিতেই অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে—এমনটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। বরখাস্ত, বদলি ও দুর্নীতি অনুসন্ধানের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে এনবিআর সংস্কারের আসল উদ্দেশ্য এবং স্বচ্ছতা-নির্ভর ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার পথ।
বাংলাবার্তা/এসজে