
ছবি: সংগৃহীত
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই সমাবেশ শেষে ফেরার পথে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের গাড়িবহরে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলায় এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী, যুগ্ম আহ্বায়ক সারজিস আলমসহ দলের শীর্ষ নেতারা কয়েক ঘণ্টা ধরে অবরুদ্ধ থাকেন। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনী থাকলেও তারা কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।
বুধবার (১৬ জুলাই) বিকেল সাড়ে চারটার পর গোপালগঞ্জ পৌর পার্কে সমাবেশ শেষে গাড়িবহর নিয়ে শহর ত্যাগ করার সময় একদল যুবক আচমকাই তাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা লাঠিসোঁটা, রড এবং দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল এবং তারা বহরের অন্তত তিনটি গাড়ির কাচ ভেঙে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ প্রথমে ফাঁকা গুলি ও টিয়ারগ্যাস ছোড়ে, কিন্তু হামলাকারীরা ছত্রভঙ্গ হওয়ার বদলে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
হামলার ঘটনায় রাজনৈতিক বক্তব্য দেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারজিস আলম। তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘গোপালগঞ্জে খুনি হাসিনার দালালেরা আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে নাটক দেখছে, পিছু হটছে। আমরা যদি এখান থেকে বেঁচে ফিরি, তাহলে মুজিববাদের কবর রচনা করেই ফিরব, না হয় ফিরব না।’ তিনি গোপালগঞ্জের বিবেকবান ছাত্র ও জনগণকে ‘দালালদের কবর রচনার’ আহ্বান জানান এবং দেশবাসীর প্রতি গোপালগঞ্জে ছুটে আসার আহ্বানও জানান।
এই পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তোলে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এদিকে গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি আরও জটিল হয় যখন জানা যায়, পুলিশ ও র্যাবের পাহারায় এনসিপি নেতাদের শহর থেকে বাইরে নিয়ে যেতে চেষ্টাকালে তাদের গাড়িবহর আবারও হামলার মুখে পড়ে। বাধ্য হয়ে পুলিশ পুরো বহর ঘুরিয়ে শহরে ফিরিয়ে আনে এবং পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিরাপদে আশ্রয় দেয়।
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা যখন রওনা দিয়েছি, তখন গ্রাম থেকে দলবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ ও ছাত্রলীগের লোকজন এসে আমাদের বহরের পথ আটকে দেয়। চারপাশ থেকে হামলা শুরু হয়। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে, কিন্তু বাস্তবে তারা কিছুই করেনি।’
এর আগে, গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্ক এলাকায় অনুষ্ঠিত এনসিপির সমাবেশেও হামলার ঘটনা ঘটে। সমাবেশ শুরুর আগেই মঞ্চে লাঠিসোঁটা হাতে প্রবেশ করে কয়েকশ’ লোক। তারা চেয়ার ভাঙচুর করে, ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে, এবং এনসিপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ তখন কিছু সময়ের জন্য পিছু হটে যায়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীও মাঠে নামে এবং সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
সমাবেশের পরের এই হামলা এবং নেতাদের অবরুদ্ধ হওয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক মহলে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেন, “গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধ্বংস করে দিয়ে আওয়ামী লীগ এখন বিরোধী দলের অস্তিত্ব মুছে দিতে চায়। গোপালগঞ্জে এনসিপির ওপর হামলা তারই প্রমাণ।”
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, ঘটনার তদন্ত চলছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। তবে হামলাকারীরা কারা, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী—সেটি এখনো স্পষ্ট করেনি জেলা পুলিশ। ঘটনার সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের কেউ কেউ বলছেন, হামলাকারীদের অনেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বুধবার সন্ধ্যার দিকে সেনাবাহিনীর একটি টহল দলও ঘটনাস্থলে গেলে তারাও কিছু সময়ের জন্য ইটপাটকেল ও উত্তেজনার মুখে পড়ে। পরে সেনা সদস্যরা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনেন। এরপর এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের গাড়িবহর নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। শেষ পর্যন্ত তাদের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ইতোমধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। কেউ যেন সভা-সমাবেশ বা মিছিল করতে না পারে, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে এনসিপি নেতারা বলছেন, তারা এই হামলার ঘটনায় মামলা করবেন এবং হামলাকারীদের নাম-পরিচয়সহ তথ্য তুলে ধরবেন। পাশাপাশি তারা দাবি করেন, সরকার চাইলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এসব হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করতে পারে, কিন্তু তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এদের আড়াল করছে।
সারাদেশে এনসিপির কর্মীদের মধ্যে এই হামলার ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। সংগঠনটি শিগগিরই ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ