
ছবি: সংগৃহীত
নামাজে সময়মতো উপস্থিত হওয়া একজন মুসলমানের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় ভিন্ন হয়। কেউ কাজে ব্যস্ত, কেউ যানজটে আটকা পড়ে বা হঠাৎ কোনো কারণে মসজিদে নামাজ শুরু হওয়ার পর পৌঁছান। এমন পরিস্থিতিতে প্রায়শই দেখা যায়—মুসল্লি মসজিদে এসে পৌঁছান, যখন ইমাম সিজদায় রয়েছেন। তখন অনেকেই দ্বিধায় পড়ে যান: এখন কি তাকবির বলে সিজদায় গিয়ে ইমামের সঙ্গে শরীক হওয়া উচিত, নাকি দাঁড়িয়ে থেকে ইমামের পরবর্তী রুকু বা দাঁড়ানোর অপেক্ষা করতে হবে?
এই প্রশ্নটির উত্তর ইসলামী শরিয়তের আলোকে অত্যন্ত স্পষ্ট এবং হাদিস শরিফে তা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ে নবী করিম (সা.)-এর নির্দেশনা ও সাহাবিদের আমল আমাদের জন্য পরিষ্কার দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
হাদিস শরিফে এসেছে, যখন কেউ মসজিদে এসে ইমামকে সিজদায় পায়, তখন সে যেন সঙ্গে সঙ্গে সিজদায় চলে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন, “তোমাদের কেউ যখন নামাজে উপস্থিত হবে, তখন ইমামকে যে অবস্থায় পাবে, সেও যেন সেই অবস্থায়ই ইমামের সঙ্গে শরীক হয়ে যায়।” (জামে তিরমিজি, হাদিস ৫৯১)
অন্য এক হাদিসে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়: “তোমরা যখন নামাজে এসে আমাদেরকে সিজদায় পাবে, তখন তোমরাও সিজদায় শরীক হয়ে যাবে। তবে ওই সিজদাকে রাকাত হিসেবে গণ্য করবে না; বরং যে ব্যক্তি রুকু পাবে, সে-ই রাকাত পেয়েছে।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৮৮৫)
অর্থাৎ, ইমাম রুকুতে থাকলে এবং মুসল্লি তাকবির বলে রুকুতে শরীক হতে পারলে সে পুরো রাকাত পেয়েছে। কিন্তু ইমাম যদি রুকু শেষ করে উঠেন এবং তখন মুসল্লি নামাজে শরীক হয়, তাহলে সে রাকাতটি পাবে না—বরং তা কাজা করতে হবে।
ইসলামী শাসনব্যবস্থায় সাহাবিদের আমল নবী করিম (সা.)-এর নির্দেশনার বাস্তব প্রতিফলন। হিশাম ইবনে উরওয়া (রহ.) তাঁর পিতা উরওয়া ইবনে যুবায়ের (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন যে, “কেউ যদি ইমামকে সিজদায় পায় এবং ইমাম দাঁড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তাহলে উরওয়া (রহ.) এ ধরনের আমল অপছন্দ করতেন।” (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস ২৬২৮)
এই রেওয়ায়েতটি স্পষ্ট করে দেয় যে, সাহাবিগণ ইমামের সিজদায় থাকাকালীন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করাকে সঠিক মনে করতেন না। বরং তাদের দৃষ্টিতে তখনই সিজদায় শরীক হওয়াই ছিল শরিয়তসম্মত ও মুস্তাহাব (সুন্নাতসুলভ) কাজ।
বর্তমান সময়ে অনেক মুসল্লি মনে করেন, সিজদার সময়ে ইমামের সঙ্গে শরীক হলে হয়তো রাকাত গণনায় সমস্যা হবে বা তা ভুলভাবে ধরা হবে। কেউ আবার সম্মানজনকভাবে দাঁড়িয়ে থেকে পরবর্তী রাকাত শুরু হলে তাতে শরীক হন।
কিন্তু এই অভ্যাসটি ইসলামী শরিয়তের আলোকে সঠিক নয়। এতে রাকাত তো পাওয়া যাবে না-ই, বরং সুন্নাত পরিপন্থী আচরণ হবে। কারণ, রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিগণ সুস্পষ্টভাবে এমন অবস্থায় ইমামের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে শরীক হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।
গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিকনির্দেশনা:
ইমাম সিজদায় থাকলে মুসল্লিও তাকবির বলে সিজদায় চলে যাবেন।
ওই সিজদা রাকাত হিসেবে গণ্য হবে না, যদি রুকু না পাওয়া যায়।
রাকাত গণনায় শুধুমাত্র রুকু পাওয়া নির্ণায়ক।
ইমামের অন্য অবস্থায় যেমন রুকু, কিয়াম বা কাওমায় পেলে মুসল্লিও একই অবস্থায় শরীক হবেন।
ইমামের সঙ্গে শরীক হওয়া যত তাড়াতাড়ি সম্ভব—এটাই সুন্নাত ও উত্তম পদ্ধতি।
বিশিষ্ট ইসলামি ফিকহ বিশারদ ইমাম সারাখসী (রহ.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল-মাবসূত-এ লিখেছেন: “মুসল্লি যখন ইমামকে পাবে, তখনই তার সঙ্গে শরীক হয়ে যাবে—তা সে যেকোনো অবস্থাতেই থাকুক। কারণ রাসুল (সা.) এ নির্দেশ দিয়েছেন।” (আল-মাবসূত, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৫)
একই কথা এসেছে ফাতাওয়া খানিয়া ও উমদাতুল কারী-তেও। তারা বলছেন, ইমামের সিজদায় থাকাকালীন দাঁড়িয়ে থাকা মাকরুহ এবং তা ইচ্ছাকৃত হলে গুনাহের শামিল হতে পারে।
ইসলামের নিয়ম-কানুন ও ইবাদতের সূক্ষ্ম দিকগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চর্চার মধ্য দিয়ে যথাযথভাবে পালন করতে হয়। ইমামকে সিজদায় পেলে দাঁড়িয়ে থেকে তার পরবর্তী রাকাতের অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গে সিজদায় শরীক হওয়াই হচ্ছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশিত সুন্নত।
অতএব, যে কোনো সময় মসজিদে এসে ইমামকে সিজদায় পেলে—সেই সময়েই তাকবির বলে সিজদায় চলে যান। এটা ইসলামী শরিয়তের স্পষ্ট নির্দেশনা, যার মাধ্যমে একদিকে সুন্নাত পালিত হয়, অন্যদিকে মুসল্লির ইবাদতের পরিপূর্ণতা রক্ষা হয়।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে নামাজ আদায়ের তাওফিক দিন।
আমিন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ