
ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি রাজধানীর মিডফোর্ড এলাকায় ঘটে যাওয়া এক নির্মম হত্যাকাণ্ড দেশবাসীকে গভীরভাবে শোকাহত করেছে। একজন নিষ্পাপ ব্যবসায়ী সোহাগকে পাথর দিয়ে পেটিয়ে হত্যা করার মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের সমাজের নৈতিক ও মানবিক পতনের একটি স্পষ্ট প্রমাণ। এটি কেবলমাত্র একটি ব্যক্তির মৃত্যু নয়, বরং পুরো জাতির বিবেকের উপর একটি বড় আঘাত।
আমরা আজ একটি উন্নত, সভ্য সমাজের কথা বলি, যেখানে মানুষ আইন, ন্যায় ও মানবিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু এ ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, মানবতার আদর্শ আজ কতটা বিলুপ্ত হয়ে আসছে। সামান্য টাকার বিনিময়ে মানুষ হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করতে দ্বিধা করেন না। একটি মানুষের জীবন যেন আজ তুচ্ছ হয়ে পরেছে। এ পরিস্থিতি দেখলে মনে হয় আমরা এক ভয়াবহ জাহিলিয়াতের যুগে প্রবেশ করেছি, যেখানে মানুষ একে অপরের প্রতি নিষ্ঠুর এবং নিজের স্বার্থে অন্যকে ধ্বংস করতে পিছপা হয় না।
এ ধরনের বর্বরতা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা নয়, বরং একটি বিস্তৃত অপরাধী চক্র ও সন্ত্রাসের অংশ। চাঁদাবাজি, হত্যাকাণ্ড, গুম, ধর্ষণ—এসব আজ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি অপরাধী নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। আর এই নেটওয়ার্ক সামাজিক ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিরাপদ জীবন কাটাচ্ছে। এদের অনেকেই সরকারি বা প্রশাসনিক সংস্থার আশ্রয়ে নিরাপত্তায় আছেন। এতে অপরাধ কমার পরিবর্তে বেড়েই চলছে।
সমাজের এই ভয়াবহ অবক্ষয়ের পেছনে রয়েছে নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষার চরম ঘাটতি। আমরা বর্তমানে এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যেখানে শিক্ষা শুধু চাকরি বা রোজগারের উপকরণ হিসেবেই পরিণত হয়েছে, চরিত্র গঠনের মাধ্যম হিসেবে নয়। ফলে গড়ে উঠছে ‘শিক্ষিত বর্বর’ যারা সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানবিকতা থেকে দূরে। তারা আইন জানলেও বিবেকহীন, ধর্মীয় শিক্ষায় দুর্বল।
এ অবস্থায় নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষার বিকল্প নেই। আমাদের মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এমন শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন যা আল্লাহভীতি ও মানবিক মূল্যবোধকে জীবনের সর্বোচ্চ অবস্থানে রাখে। ইসলামে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি একজন নিরপরাধ মানুষের জীবন নাশ করে, সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করেছে (সূরা মায়েদা: ৩২)।
খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড থাকলেও তা কার্যকর করা অত্যন্ত ধীর। বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা অপরাধীদের উৎসাহিত করছে। তাই দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাথর দিয়ে হত্যাকাণ্ডের মতো বর্বর অপরাধের জন্য দ্রুত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা অপরিহার্য। এই শাস্তি জনসমক্ষে কার্যকর করা হলে অন্যদের জন্য এক শক্তিশালী সতর্কতা হবে। যতদিন আইন শৃঙ্খলা দুর্বল থাকবে, অপরাধীর সাহস বাড়তেই থাকবে।
চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে সমাজের নৈতিক ও শান্তিপ্রিয় মানুষদের একত্রিত হতে হবে। প্রত্যেক পাড়া-মহল্লায় ‘অপরাধ প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের প্রতি নজরদারি চালাতে হবে। প্রশাসনের সহযোগিতায় সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সিসিটিভি ক্যামেরা, আলোকসজ্জা ও স্থানীয় নজরদারি বাড়িয়ে অপরাধীদের কার্যক্রম সীমিত করতে হবে।
আমাদের নীরবতা নয়, প্রতিবাদ ও সাহসী অবস্থান সমাজ রক্ষার মূল হাতিয়ার। সামাজিক সচেতনতা বাড়িয়ে ‘চাঁদাবাজি’ এবং সন্ত্রাসকে ছড়িয়ে পড়া থেকে আটকাতে হবে।
বর্তমানে চাঁদাবাজি আরেক মাত্রা পেয়েছে—সশস্ত্র ও সংঘবদ্ধ অপরাধে রূপান্তরিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা গ্যাং সদস্যরা এলাকার ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজেদের ‘নিজস্ব এলাকা’ দাবি করে। তারা নিয়মিত চাঁদা আদায় করে, বিরোধীদের শাস্তি দেয়। এমন পরিস্থিতি প্রতিরোধ না করলে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সোহাগের হত্যা কেবলমাত্র একজন প্রাণহানির ঘটনা নয়, এটি আমাদের জাতির নৈতিক ও মানবিক বিবেকের মৃত্যু। আমরা যদি আজ এই নির্মমতার বিরুদ্ধে একজোট না হই, প্রতিবাদ না করি, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেই, তবে আগামীকাল আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।
আজই সময় এসে গেছে—আমাদের নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তা সমাজে পুনরুদ্ধার করতে। দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করে, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে, একসঙ্গে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আমরা অপরাধ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারি।
লেখক: মুহাদ্দিস, ছারছীনা দারুস্সুন্নাত জামেয়ায়ে নেছারিয়া দীনিয়া, নেছারাবাদ, পিরোজপুর
বাংলাবার্তা/এমএইচ