
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের শুল্ক আলোচনা এখন আর শুধু বাণিজ্যিক পরিসরে সীমাবদ্ধ নেই—বরং এর পরিধি সম্প্রসারিত হয়ে পৌঁছেছে নিরাপত্তা, কৌশলগত মিত্রতা ও ভূরাজনৈতিক অঙ্গীকারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র মূলত বাংলাদেশকে চীনের প্রভাববলয় থেকে দূরে রাখতে সচেষ্ট। পাশাপাশি তারা চায়, বাংলাদেশ যেন ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের (Indo-Pacific Strategy/IPS) কৌশলগত কাঠামোর পক্ষে অবস্থান নেয়। তবে বিষয়টি এখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে গভীর আলোচনার দাবি রাখে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফা শুল্ক আলোচনা ঘিরে দেশের ভেতরে এবং বাইরে নানা পর্যবেক্ষণ শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (USTR) কার্যালয়ের সঙ্গে হওয়া এই আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা।
আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকটি স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিষয় সংযুক্ত করেছে। বিশেষ করে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির বিষয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে, তারা চায় না বাংলাদেশ চীনের দিকে অতিরিক্ত ঝুঁকে যাক। বিশেষ করে অবকাঠামো, প্রযুক্তি, নিরাপত্তা ও বন্দর উন্নয়নে চীনা অংশগ্রহণে তাদের আপত্তি রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশল নতুন নয়—তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং আফ্রিকার নির্দিষ্ট অংশেও এ ধরনের প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে।
সূত্রগুলো আরও জানায়, আলোচনায় একটি বিতর্কিত প্রস্তাবও তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা চায়, যদি কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তবে বাংলাদেশকেও সেই নিষেধাজ্ঞা অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ, যদি যুক্তরাষ্ট্র চীন, রাশিয়া কিংবা ইরানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়, তবে বাংলাদেশকে সেইসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সীমিত বা বন্ধ রাখতে হবে।
এছাড়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো—যেসব মার্কিন পণ্যকে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে, সেগুলো যেন অন্য কোনো দেশ না পায়। এই শর্ত বিশ্লেষকদের কাছে "বাণিজ্যিক স্বাধীনতার ওপর বড় রকমের চাপ" হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান রোববার সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই আলোচনার প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় দফা আলোচনায় একটি প্রাথমিক ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে। এই চুক্তির মধ্যে নিরাপত্তা বিষয়ক কিছু শর্তও আছে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি মূলত আইপিএস-এর একটি কার্যকর রূপ। এখানে শুধু অর্থনীতি নয়, সামরিক সহযোগিতা, সাইবার নিরাপত্তা, সামুদ্রিক নজরদারি ও অবকাঠামো সহায়তা যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ওয়াশিংটন থেকে ফিরে সোমবার ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান, “যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ অ-বাণিজ্যিক শর্ত ছিল। তবে গোপনীয়তা চুক্তির কারণে সব কিছু খোলাসা করে বলা সম্ভব নয়।”
তিনি আরও বলেন, “তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনার জন্য প্রস্তুতি চলছে। আমরা সময় চেয়েছি। আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝি আলোচনার তারিখ নির্ধারণ হতে পারে।”
পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ হোসেন বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশকে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরিয়ে তাদের কৌশলগত বলয়ের অংশ করতে। এটি শুধু বাণিজ্য নয়, এটা এক ধরনের নিরাপত্তা অঙ্গীকার, যেখানে ভবিষ্যতে সামরিক ও প্রযুক্তিগত জোটবদ্ধতার সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে।”
অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. নাজমুল আহসান বলেন, “যদি শুল্ক সুবিধা পেতে হলে রাজনৈতিক শর্ত মানতে হয়, তাহলে সেটা বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। চীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার—এই বাস্তবতা উপেক্ষা করা কঠিন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহীন সিদ্দিকীর মতে, “এটা স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আইপিএস-এর একটি বলিষ্ঠ অংশীদার হিসেবে দেখতে চায়। তবে তার জন্য যেসব শর্ত দেওয়া হচ্ছে, তা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভারসাম্যের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে।”
বাংলাদেশ সরকার সূত্র বলছে, আলোচনায় দেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহ রয়েছে। তবে এককভাবে কোনো বলয়ে প্রবেশ না করে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি বজায় রাখাই সরকারের নীতিগত অবস্থান।
একজন জ্যেষ্ঠ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে দেখি, কিন্তু চীনও আমাদের অবকাঠামো ও বিনিয়োগের অন্যতম সহায়তাকারী। তাই ভারসাম্য রক্ষা করেই এগোতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের শুল্ক আলোচনায় এখন আর শুধু পণ্য আদান-প্রদান নয়, জড়িয়ে পড়েছে ভূরাজনৈতিক সমীকরণ, নিরাপত্তা জোট, কৌশলগত অবস্থান ও বিদেশ নীতি। এই আলোচনার ফলাফল নির্ভর করবে বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের দক্ষতা, দূরদর্শিতা এবং জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষার অঙ্গীকারের ওপর।
বিশ্লেষকদের মতে, অতীতের মতো ‘এক বলয়ের নির্ভরতা’ থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশকে বহুমাত্রিক কূটনীতির পথে হাঁটতে হবে, যাতে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা—উভয়ই টিকে থাকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ