
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি বিশ্বব্যাংকের গভীর আস্থা এবং আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের নবনিযুক্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট জোহানেস জুট। আগামী তিন বছর প্রতি বছর ৩ বিলিয়ন ডলার করে বাংলাদেশকে অর্থায়ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সংস্থাটি।
সোমবার (১৪ জুলাই) রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে এই প্রতিশ্রুতি দেন জোহানেস জুট। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ভুটানের নবনিযুক্ত বিভাগীয় পরিচালক জিন পেসম ও প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফা সিদ্দিকী।
বৈঠকে জোহানেস জুট বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি এবং আর্থিক খাতে অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কার কর্মসূচির প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আমি এই অঞ্চলের কান্ট্রি ডিরেক্টর ছিলাম। বাংলাদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার হৃদয়ের কাছাকাছি।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা শুধু আর্থিক নয়, বরং কৌশলগত। আমরা চাই এই দেশের মানুষ তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে অগ্রসর হোক। আগামী তিন বছরে আমরা বাংলাদেশে বছরে ৩ বিলিয়ন ডলার করে সহায়তা দিতে প্রস্তুত। গত অর্থবছরেও আমরা ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থায়ন করেছি।”
বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে দেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, “বিশ্বের অনেক দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংকট থাকলেও বাংলাদেশে তা বিপরীত। এখানে বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম যুবক-যুবতী রয়েছে, যাদের জন্য বিশ্বব্যাংক নানা কর্মসূচিতে সহায়তা করতে চায়।”
তিনি বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়নে ইউনূসের অবদানের প্রশংসা করে জানান, “বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাংলাদেশে যে নারী শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচি চলছে, তা আজ দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল হয়ে উঠেছে।”
জোহানেস জুট বলেন, “আমরা শুধু উন্নয়ন সহযোগী নই, আমরা এই দেশের অংশীদার। আমরা বাংলাদেশকে একটি ভৌগোলিক সীমারেখা হিসেবে নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির সম্ভাবনাময় কেন্দ্র হিসেবে দেখি।”
বৈঠকে জোহানেস জুট গত বছরের জুলাই আন্দোলনে প্রাণ হারানো ছাত্র-তরুণদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। তিনি বলেন, “এই ঘটনা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এ অঞ্চলের সবার জন্যই মর্মস্পর্শী ছিল। তরুণদের এই আত্মত্যাগ ইতিহাসে লেখা থাকবে।”
বৈঠকে বক্তব্যে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমরা যখন এই দায়িত্ব নিই, তখন বাংলাদেশ একটি বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন ভূমিকম্পের পরে জায়গাটি দাঁড়িয়ে আছে। সেই সময় আপনারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আপনাদের সহায়তায় আমরা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি।”
তিনি বলেন, “গত জুলাইয়ের আন্দোলনে আমাদের তরুণরা—বিশেষ করে মেয়েরা—যে সাহসিকতা দেখিয়েছে, তা আমাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। এজন্য আমরা ১৪ জুলাইকে নারী দিবস হিসেবে পালন করছি। এই ত্যাগ বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। তরুণরাই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ।”
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, “আমরা উন্নয়ন অংশীদারদের আহ্বান জানিয়েছি, যেন তারা বাংলাদেশকে শুধু একটি ছোট দেশ হিসেবে না দেখে। আমাদের রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা—সমুদ্র, বন্দর, মানবসম্পদ, এবং ভৌগোলিক সুবিধা। আমরা চাই বাংলাদেশকে আঞ্চলিক শিল্প উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে। ইতোমধ্যেই আমরা বিদেশি কারখানা বাংলাদেশে আনতে আহ্বান জানিয়েছি।”
সভায় উপস্থিত প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফা সিদ্দিকী চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) সংক্রান্ত একটি হালনাগাদ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, নতুন ব্যবস্থাপনার আওতায় বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
এছাড়া তিনি জানান, ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে বাংলাদেশে নেট বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো: কোম্পানিগুলোর ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি এবং ইকুইটি বিনিয়োগে ইতিবাচক পরিবর্তন।
এই বৈঠক ছিল শুধু আর্থিক প্রতিশ্রুতি দেওয়ার একটি ঘটনা নয়—এটি ছিল একটি বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আস্থা পুনর্ব্যক্তের মুহূর্ত। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, তরুণ সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্বব্যাংকের ৩ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক সহায়তা শুধু বর্তমান নয়, আগামী দিনের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ আশ্বাস। এই অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশ উন্নয়ন ও অগ্রগতির এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ