
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য টেক্সটাইল খাত বর্তমানে নানা সংকটের মুখে পড়েছে। প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার বা আনুমানিক আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকা এই খাতটি এখন ধুঁকছে, এবং নানা জটিল সমস্যার কারণে শিল্পীরা নিজেদের কারখানা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। গত এক বছরে ২০টিরও বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, এবং প্রায় ৪০ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান বিপন্ন হওয়া এই খাতের বর্তমান সংকটের মাত্রা তুলে ধরে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) অনুযায়ী, প্রাইমারি টেক্সটাইল সেক্টরের সবচেয়ে বৃহৎ সংগঠন বিটিএমএ-র সদস্য প্রতিষ্ঠান সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৮৫৮টি। স্পিনিং, উইভিং, ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিল অন্তর্ভুক্ত এই খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বেসরকারি খাতের একক বিনিয়োগ হিসেবে সর্বোচ্চ। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল খাত থেকে, যেখানে টেক্সটাইল খাত তৈরি পোশাক খাতের ৭০ শতাংশ কাঁচামাল সরবরাহ করে।
তবে বিগত কয়েক বছর ধরে উৎপাদন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি নানা সমস্যার কারণে শিল্পগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি, ডলারের সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন, ব্যাংকের ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের ঘাটতি, নগদ প্রণোদনার কমে যাওয়া, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানিতে জটিলতা—এসব কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে এবং বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে।
বিটিএমএ-র সহ-সভাপতি মো. সালেউদ জামান খান বলেন, “এক সময় গ্যাসের দাম ছিল অত্যন্ত কম, যা আমাদের ব্যবসায় টিকে থাকার অন্যতম শক্তি ছিল। এখন গ্যাসের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। সরকারি প্রণোদনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাশের দেশগুলো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা পাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “পাশাপাশি আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আগাম আয়কর দিতে বাধ্য হচ্ছি। আয়কর প্রত্যাহার না হলে শিল্প স্থবির হয়ে যাবে। তুলা আমদানিতে ২ শতাংশ আগাম আয়কর আরোপ শিল্পের ওপর অতিরিক্ত বোঝা সৃষ্টি করেছে।”
বিটিএমএ পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “কারখানা গুলোতে গ্যাস সরবরাহ নেই, ব্যাংক ঋণের সমস্যা ও আগাম আয়কর নিয়ে আমরা চরম সংকটে পড়েছি। অনেক শিল্প মালিক এখন কারখানা বিক্রি করে দিতে চাইছেন। উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”
অন্যদিকে, বিটিএমএ পরিচালক প্রকৌশলী রাজীব হায়দার বলেন, “গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা, ঋণের সুদের হার বৃদ্ধিসহ আগাম আয়কর সমস্যার কারণে আমরা প্রতিদিনই সমস্যায় পড়ছি। পাশের দেশগুলো where আমাদের চেয়ে বেশি প্রণোদনা পাচ্ছে। আমাদের সুতা এবং কাপড়ের কারখানা বন্ধ হতে শুরু করলে গার্মেন্টস সেক্টরও শীঘ্রই সংকটে পড়বে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “যদি আমরা এখনই উদ্যোগ না নেই, তবে খুব শীঘ্রই এই শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়বে। আমাদের দেশের পলিসি আর প্রতিবেশীদের পলিসির মধ্যে বড় ফারাক আছে।”
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল উল্লেখ করেন, “গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম একরকম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ডলারের সংকট ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কর্মক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল কমছে। ব্যাংকের সুদের হার বেড়ে ৯ শতাংশ থেকে ১৫-১৬ শতাংশে পৌঁছেছে। রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনা অনেক কমে গেছে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ থেকে বিনা শুল্কে সুতা আমদানির ফলে দেশীয় শিল্পের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “গত ৭ জুলাই সরকারের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় ২ শতাংশ আগাম আয়কর শুল্ক প্রত্যাহারের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এখনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এতে প্রতিবেশী দেশগুলো আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে এবং আমাদের শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
অর্থনীতিবিদ ড. ফারুক আহমেদ বলেন, “টেক্সটাইল খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি প্রাণ কেন্দ্র। এই খাতের অবস্থা দেশের রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। বর্তমানে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, ঋণের হার বৃদ্ধি এবং আগাম আয়কর প্রত্যাহারের অনিশ্চয়তা খাতের জন্য মারাত্মক। সরকারের উচিত দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া।”
শিল্প বিশ্লেষক সুমন চৌধুরী বলেন, “টেক্সটাইল খাতের সংকট শুধু শিল্প মালিকদের জন্য নয়, পুরো দেশের জন্য। শিল্প বন্ধ হলে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট হতে পারে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। কর নীতি পুনর্বিবেচনা, প্রণোদনার পুনর্বিন্যাস এবং গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনা জরুরি।”
বিশ্লেষকদের মতে, টেক্সটাইল খাতের স্থিতিশীলতার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন— গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য সুষ্ঠু ও ন্যায্য নির্ধারণ, আগাম আয়কর শুল্ক প্রত্যাহার ও কর কাঠামোর পুনর্বিন্যাস, ব্যাংক সুদের হার নিয়ন্ত্রণে আনা, রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনা পুনরুদ্ধার, তুলা ও ফাইবার আমদানিতে শুল্ক মুক্তির ব্যবস্থা।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সমতা নিশ্চিত করার জন্য নীতি প্রণয়ন
টেক্সটাইল খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। কিন্তু বর্তমানে নানা সমস্যা এবং নীতিগত শিথিলতার কারণে এই খাত সংকটে পড়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। শিল্প মালিক, কর্মী, ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা একযোগে সরকারের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। সময় নষ্ট করলে বিনিয়োগের এই বিশাল পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি হবে এবং দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ে পড়বে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ