
ছবি: সংগৃহীত
মাত্র সাত মাস আগেই আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)–এর অধীন আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট। কার্যক্রম শুরুর পরপরই এই নবগঠিত ইউনিট যে মাত্রায় সক্রিয়তা, পেশাদারিত্ব এবং গোয়েন্দা দক্ষতা দেখিয়েছে, তা দেশের রাজস্ব প্রশাসনের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হয়ে উঠেছে।
ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত এই সাত মাসের মধ্যে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট মোট ১৮৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগে প্রাথমিক তদন্ত পরিচালনা করেছে। সেই তদন্তে ১,৮৭৪ কোটি টাকার কর ফাঁকির সুনির্দিষ্ট তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। কর ফাঁকির বিপরীতে আইনি প্রক্রিয়ায় ২৩১টি এ-চালানের মাধ্যমে ৬৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে ১১৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়েছে।
এনবিআরের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, সদ্য গঠিত ইউনিটটি মানবসম্পদ ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ শক্তি ও কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে একটি স্বচ্ছ, তথ্যভিত্তিক ও প্রযুক্তিনির্ভর কর তদন্ত কাঠামো গড়ে তুলেছে। তাদের এ ধরনের উদাহরণমূলক ও অনুকরণীয় কর্মকাণ্ড রাজস্ব আদায় ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “প্রথমেই স্বীকার করতে হবে, আমাদের ইউনিটে এখনও কাঙ্ক্ষিত জনবল নেই, অনেক ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ লজিস্টিক সাপোর্টও নেই। কিন্তু আমরা আমাদের মৌলিক দায়িত্ব পালন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কর ফাঁকি, অর্থ পাচার ও বেনামি সম্পদের বিরুদ্ধে আমরা তথ্যনির্ভর ও বাস্তবভিত্তিক তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা ট্যাক্সপেয়ারের ভোলার সময় শেষ করতে চাই। সঠিকভাবে কর না দিয়ে, আয় গোপন করে, ব্যাংক হিসাবের বাইরে সম্পদ সঞ্চয় করে আর কেউ পার পাবে না—এই বার্তাটি আমরা শক্তভাবে দিতে চাই।”
সূত্র জানায়, কর ফাঁকির নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব আদালতের অনুমোদনে জব্দ করা হয়েছে। এই হিসাবগুলো এখন তদন্তাধীন এবং প্রক্রিয়া শেষে আরও বড় অঙ্কের রাজস্ব রাজস্ব পুনরুদ্ধার সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।
আয়কর গোয়েন্দা ইউনিটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা একদিকে করদাতাদের স্বেচ্ছায় সঠিক আয় ঘোষণা এবং কর প্রদানে উৎসাহিত করছে, অন্যদিকে কর ফাঁকি, বেনামি সম্পদ, এবং অর্থ পাচার রোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা সবসময় চাই কেউ যেন ভয় না পায়, তবে কেউ যেন আইনের ফাঁক দিয়ে পারও না পায়। আয় গোপন করে শুধু নিজের উন্নতি নয়, সেটা দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করছি।”
প্রযুক্তিনির্ভর তদন্ত কাঠামো গড়ে তুলতে শুরু করেছে ইউনিটটি। রাজস্ব গোয়েন্দা কার্যক্রমে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন তথ্যভাণ্ডার (ডেটাবেস), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অ্যালগরিদম এবং রিস্ক প্রোফাইলিং টুল। অর্থাৎ যেসব করদাতা হঠাৎ সম্পদে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেখিয়েছেন বা যাদের ব্যয় ধরণ আয় ঘোষণা থেকে একেবারে ভিন্ন, তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইউনিটের নজরে আসছেন।
এনবিআর-এর এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা এই ইউনিটকে ভবিষ্যতে একটি অটোনোমাস, আধুনিক এবং সুদক্ষ গোয়েন্দা সংস্থায় রূপ দিতে চাই, যারা দেশের কর সংস্কৃতিতে বিশ্বাসযোগ্যতা ফেরাবে। জনমনে বার্তা যাবে—রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আর কেউ পার পাবে না।”
তিনি আরও বলেন, “এই ইউনিটের সফলতা শুধু টাকায় মাপা যাবে না। এটি কর সংস্কৃতি গঠনে, জবাবদিহিতা বাড়াতে এবং প্রশাসনে সুশাসনের বার্তা দিতে বড় ভূমিকা রাখছে। আমাদের পরিকল্পনায় রয়েছে ইউনিটটিকে আরও সম্প্রসারণ, বিভাগীয় পর্যায়ে উপকেন্দ্র খোলা এবং স্বতন্ত্র লিগ্যাল সেল গঠন।”
বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপে যেখানে বাংলাদেশের রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা প্রায়ই অর্জিত হচ্ছে না, সেখানে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের এই পারফরম্যান্স বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু রাজস্ব পুনরুদ্ধার নয়, দীর্ঘমেয়াদে করদাতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি, কর পরিহার রোধ, এবং কর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইউনিটটি মুখ্য ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছে এনবিআর।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এরই মধ্যে এক বিবৃতিতে বলেন, “এই ইউনিট সরকারের রাজস্ব কাঠামোর অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠবে। আমরা বিশ্বাস করি, জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে কর সংগ্রহই হবে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত।”
নতুনভাবে যাত্রা শুরু করা আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের প্রথম সাত মাসের পারফরম্যান্স প্রমাণ করেছে—সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, আন্তরিকতা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করেই রাজস্ব ব্যবস্থার দুর্বল জায়গাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। রাজস্ব ফাঁকিবাজদের জন্য এটি অবশ্যই সতর্কবার্তা, আর দেশের সচেতন করদাতাদের জন্য এটি আশাবাদের প্রতিচ্ছবি।
একটি স্বচ্ছ, ন্যায়নিষ্ঠ ও প্রযুক্তিভিত্তিক রাজস্ব প্রশাসনই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গঠনে সহায়ক হবে—এটাই এই ইউনিটের মূল বার্তা।
বাংলাবার্তা/এসজে