
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের টানা ৯ মাসের সামরিক অভিযান এখন মানবিক বিপর্যয়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে। প্রতিদিনের মতো রক্ত ঝরছে, ধ্বংসস্তূপ বাড়ছে, আর লাশের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, রোববার (১৩ জুলাই) ইসরাইলি বাহিনীর নতুন করে চালানো একাধিক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় আরও অন্তত ৯৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর ফলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে চলা ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার ২৬ জনে।
বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার বরাত দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নিহতদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক নারী, শিশু এবং সেবাদানকারী চিকিৎসক রয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজারের মতো মানুষ, যাদের অনেকেই মারাত্মকভাবে পঙ্গু হয়েছেন বা স্থায়ী মানসিক ট্রমায় ভুগছেন।
রোববার গাজার উত্তরাংশের ঘনবসতিপূর্ণ একটি বাজারে চালানো বিমান হামলায় কমপক্ষে ১৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ডা. আহমেদ কান্দিল—গাজার অন্যতম খ্যাতনামা ও বয়োজ্যেষ্ঠ একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, যিনি যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই যুদ্ধাহতদের সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন। স্থানীয়রা বলছেন, তিনি কোনোদিন গাজা ছাড়েননি, বরং নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “বাজার ছিল লোকজনে পরিপূর্ণ। সবাই খাদ্য ও পানি সংগ্রহে এসেছিলেন। হঠাৎ একটি বিশাল বিস্ফোরণে চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। অনেকের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। কান্দিল স্যার সেখানেই ছিলেন।”
এই হামলা একদিকে যেমন চিকিৎসা খাতের ক্ষতি, তেমনি প্রতীকীভাবে ফিলিস্তিনিদের মনোবলের ওপরও এক বড় আঘাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
একইদিনে গাজার মধ্যাঞ্চলের নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে আরেকটি ভয়াবহ হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী। হামলার লক্ষ্য ছিল একটি পানির সংগ্রহস্থল, যেখানে মানুষ—বিশেষ করে শিশুরা—লাইনে দাঁড়িয়ে তাদের পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহ করছিল। এই হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন, যাদের অধিকাংশই শিশু। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৭ জন।
প্রত্যক্ষদর্শী মুস্তাফা আল-ঘানিম বলেন, “বাচ্চারা চুপচাপ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। কারও হাতে পানির বোতল, কারও হাতে কলসি। ঠিক তখনই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। আমি শুধু শিশুদের কান্না ও আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলাম।”
ইসরাইলি সেনাবাহিনী এই হামলার দায় স্বীকার করে বলেছে, তাদের লক্ষ্য ছিল একজন ‘সশস্ত্র ফিলিস্তিনি যোদ্ধা’। তবে তাদের দাবি, ‘কারিগরি ত্রুটির’ কারণে ক্ষেপণাস্ত্রটি ভুলভাবে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে নিরীহ মানুষের ভিড়ে আঘাত হানে। যদিও এ ধরনের দাবিকে ভিত্তিহীন ও আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মতে, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা ‘কল্যাটারাল ড্যামেজ’ অজুহাত দেখিয়ে বেসামরিক লোকজনকে হত্যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের শামিল।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইসরাইলি বাহিনীর টানা ৯ মাসের আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৮,০২৬ জনে। এদের মধ্যে অন্তত ৫২ শতাংশই নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০ জন। গাজা শহরসহ দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস, দেইর আল-বালাহ, নুসেইরাত, রাফাহ এবং জাবালিয়া শরণার্থী শিবির সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গাজায় এখন অন্তত ৬ লাখ ৫০ হাজার শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে এবং তারা ‘দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে’ রয়েছে।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, গাজার ৮০ শতাংশ অবকাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, আশ্রয়কেন্দ্র—কোনো কিছুই বাদ যায়নি ইসরাইলি হামলা থেকে।
বাঁচার তাগিদে বহু মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানির অভাব, বিদ্যুৎ নেই, ন্যূনতম ওষুধ নেই।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (WFP) তথ্য অনুযায়ী, গাজায় ১০ লাখ মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। অনেক পরিবার দিনে এক বেলা খেয়েই বাঁচার চেষ্টা করছেন।
আন্তর্জাতিক মহলের বারবার উদ্বেগ এবং যুদ্ধবিরতির আহ্বান সত্ত্বেও ইসরাইলের সামরিক অভিযান থামছে না। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো মিত্র দেশগুলো একদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ‘গভীর উদ্বেগ’ জানালেও, অন্যদিকে অস্ত্র ও গোয়েন্দা সহায়তা অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জাতিসংঘের একাধিক প্রস্তাব পাস হলেও নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের দ্বিমত ও ভেটোর কারণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ সম্ভব হয়নি। এই কূটনৈতিক জড়তায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ ফিলিস্তিনিরাই।
ইসরাইলি হামলায় বহু চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় গাজার স্বাস্থ্যখাত কার্যত ধসে পড়েছে। যেটুকু হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্র এখনো সচল, সেগুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ডাক্তার ও ওষুধের মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে বহু স্বাস্থ্যকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সংস্থা Médecins Sans Frontières (MSF) জানিয়েছে, গাজায় তারা এখন আর টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিতে পারছে না। তাদের মতে, “এটা কোনো সাধারণ সংকট নয়, এটা একসঙ্গে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, রোগ এবং অবরোধের ভয়ঙ্কর সংমিশ্রণ।”
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি জানিয়েছেন, “গাজা যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি, এবং হামাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে।” অর্থাৎ, যে মানবিক বিপর্যয়টি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘ওপেন এয়ার প্রিজন’ হিসেবে পরিচিত গাজা উপত্যকায় চলছে, তা আরো দীর্ঘায়িত হতে চলেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইল হয়তো যুদ্ধজয়ের পথে আছে—কিন্তু মানবতার পরাজয় যে অনিবার্য, তা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। এবং প্রশ্ন উঠছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ঠিক কত মানুষের মৃত্যু হলে এই সহিংসতা থামাতে কার্যকর ভূমিকা নেবে?
গাজায় প্রতিদিন মানুষ মরছে—নিরীহ, নিরস্ত্র, দুর্বল মানুষ। শিশুরা পানি আনতে গিয়ে বিস্ফোরণে উড়ে যাচ্ছে, চিকিৎসকরা রক্তাক্ত অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এই নিষ্ঠুরতা কতদিন চলবে? মানবাধিকার কি শুধু শব্দমাত্র? আন্তর্জাতিক আইন কি শুধুই কাগজে লেখা?
আজ যখন নিহতের সংখ্যা ৫৮ হাজার ছাড়িয়েছে, তখন এ প্রশ্নগুলো আরও জোরালোভাবে সামনে এসেছে। গাজার মানুষ হয়তো যুদ্ধ চায়নি, কিন্তু এখন তাদের অস্তিত্বই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই হত্যাযজ্ঞ থামাতে না পারলে মানবসভ্যতা নিজেরই মানবতা হারাবে। গাজায় প্রতিটি মৃত্যু তাই শুধু একটি প্রাণ হারানো নয়—তা আমাদের নীরবতা, নিষ্ক্রিয়তা এবং কূটনৈতিক ব্যর্থতার আরেকটি লজ্জাজনক দলিল হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ