
ছবি: সংগৃহীত
২০২৫ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ, ওয়াসিমসহ অন্যান্য শহীদদের জাতীয় বীর ঘোষণার দাবিতে দায়ের করা একটি রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। হাইকোর্ট রুল জারি করে জানতে চেয়েছে, কেন এ শহীদদের 'জাতীয় বীর' হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়া হবে না।
একইসঙ্গে আদালত আরও জানতে চেয়েছে, আন্দোলনে প্রাণ উৎসর্গ করা অন্যদের প্রকৃত ও নির্ভরযোগ্য তালিকা তৈরি করে তা কেন সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে না এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে কেন 'নতুন বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কারক' হিসেবে ঘোষণা করা হবে না।
সোমবার (১৪ জুলাই) বিচারপতি ফাহমিদা কাদেরের একক বেঞ্চ এই রুল জারি করেন। এই রুলকে অনেকেই চলমান রাজনৈতিক ইতিহাসের এক নতুন মাইলফলক বলে অভিহিত করছেন।
২০২৫ সালের জুলাই-আগস্ট মাসজুড়ে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান ছিল সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম বড় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ। ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ থেকে শুরু হওয়া এই গণআন্দোলন পরিণত হয় সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ছাত্র-যুবদের এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধে। দেশের প্রতিটি জেলা, বিশ্ববিদ্যালয়, থানা শহর ও সড়কে গড়ে ওঠে ছাত্র-জনতার ঢল।
এই আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হন বহু ছাত্র-তরুণ। আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ ও ওয়াসিম—এই তিনজন আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন, যারা জীবন দিয়েছেন নতুন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নে। এদের মধ্যে আবু সাঈদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মুগ্ধ ঢাকা কলেজের এবং ওয়াসিম সরকারি তিতুমীর কলেজের।
তাদের রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার শাহবাগ, রাজশাহীর বিনোদপুর, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, খুলনার নিউমার্কেট এবং সিলেটের বন্দরবাজার এলাকা। সেই সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ‘তাদের রক্ত বৃথা যাবে না’ স্লোগান।
সোমবারের শুনানিতে রিটের পক্ষে ছিলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি আদালতে বলেন, “নতুন প্রজন্ম রক্ত দিয়েছে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু এখনও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এটি ইতিহাসের প্রতি অন্যায় ও অবিচার।”
তিনি আরও বলেন, “যেসব তরুণ শহীদ হয়েছেন, তারা আমাদের জাতীয় আত্মপরিচয়ের অংশ হয়ে গেছেন। তাই তাদের জাতীয় বীর ঘোষণা করা সময়ের দাবি।”
আদালত রুলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ—মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের চার সপ্তাহের মধ্যে এই রুলের জবাব দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইকরামুল কবির। তিনি আদালতে বলেন, “রুলের বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিবেচনায় নেওয়া হবে।”
এই রিটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘নতুন বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কারক’ ঘোষণা করার দাবি।
রিটে বলা হয়, “ড. ইউনূস দেশের সবচেয়ে সংকটময় সময়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার ভার নিয়েছেন এবং দলীয় দুঃশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করেছেন। তিনি কেবল অর্থনীতিবিদ নন, নৈতিকতা ও আদর্শের প্রতীক। তার নেতৃত্বে দেশে শুদ্ধি অভিযান, বিচার সংস্কার, প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন এবং অর্থনৈতিক উত্তরণ সূচিত হয়েছে। এ জন্য তিনি ইতিহাসে স্থান পাওয়ার যোগ্য।”
আদালত রুলে জানতে চেয়েছেন, এই দাবিটি কেন বিবেচনায় নেওয়া হবে না এবং তাকে জাতীয় সম্মাননা প্রদানের বিষয়ে সরকার কেন পদক্ষেপ নেবে না।
সোমবারের এই রুল জারির পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। অনেকে এটিকে “তরুণদের আত্মত্যাগের প্রতি রাষ্ট্রের প্রথম নৈতিক জবাবদিহি” বলে মনে করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুবুল করিম বলেন, “আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধরা এখন কেবল ব্যক্তি নন, তারা প্রতীক হয়ে উঠেছেন একটি পরিবর্তনকামী প্রজন্মের। তাদের স্বীকৃতি না দিলে জাতি তার অতীত ও ভবিষ্যৎ—দুই দিক থেকেই বিচ্যুত হবে।”
অন্যদিকে, মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, “ড. ইউনূস নিজেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে দূরে রেখেও যেভাবে জাতীয় সংকটে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেটি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে।”
এই রুল বাস্তবায়ন হলে তা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ স্বীকৃতি পাওয়ার ঘটনা। একইসঙ্গে এটি নতুন ধরনের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের সূচনাও ঘটাতে পারে, যেখানে ব্যক্তি নেতৃত্ব ও নৈতিকতার ভিত্তিতে জাতীয় সম্মান দেওয়া হবে।
চার সপ্তাহ পর এই রুলের শুনানির দিন নির্ধারিত হবে, যেখানে রাষ্ট্রপক্ষের জবাবের ভিত্তিতে হাইকোর্ট চূড়ান্ত আদেশ দেবেন। আন্দোলনে প্রাণ হারানো শহীদদের পরিবার ও সচেতন নাগরিক সমাজ এই রুলকে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে দেখছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ