
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যতম প্রধান নিউমোরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। দীর্ঘদিন যাবত সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড কর্তৃক পরিচালিত এই টার্মিনালটির দায়িত্ব ৭ জুলাই ২০২৫ থেকে নৌবাহিনী গ্রহণ করেছে। এর ফলে বন্দরে গড়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কার্যক্রমে ইতিবাচক উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় নৌবাহিনী পরিচালিত চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেড এই দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন গড়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি মাসের ৭ থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত মাত্র ৭ দিনে ১০টি জাহাজের কনটেইনার লোডিং ও আনলোডিং কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে এনসিটির ৪টি জেটিতে সমান্তরালভাবে ৪টি জাহাজে অপারেশন পরিচালিত হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূস এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান, সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে চুক্তি মেয়াদ শেষ হয়ে ৬ জুলাই ২০২৫ তারিখে শেষ হয়। এরপর ৭ জুলাই থেকে নৌবাহিনী দায়িত্ব নেয়ার পর গড়ে প্রতিদিন কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৩,১৮১ টিইইউএস (TEUs), যেখানে এর আগের ৭ দিনে (১ থেকে ৬ জুলাই) গড় ছিল ২,৯৫৬ টিইইউএস। অর্থাৎ, নৌবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণের পর গড়ে প্রায় ২২৫ টিইইউএস বা ৭.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এটি সরকার এবং বন্দরের জন্য একটি ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এই ফলাফল সামগ্রিক বন্দর ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও গতিশীলতার প্রতিফলন বলে অভিহিত করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি এম.এ. কুদ্দুস বলেন, “নৌবাহিনী যখন বন্দরের দায়িত্ব নিয়েছে, তখন তারা তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে বন্দর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা এবং দ্রুততা এনেছে। এর ফলে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের গতি বেড়েছে এবং গ্রাহকদের সন্তুষ্টিও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “বন্দর ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, কর্মী প্রশিক্ষণ, এবং আধুনিক সরঞ্জাম যুক্ত করার মাধ্যমে এই গতি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগ।”
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, জানান, “নৌবাহিনীর স্বচ্ছ ও ধারাবাহিক ব্যবস্থাপনা এনসিটির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করেছে। বিশেষ করে জাহাজের ক্রমাগত ওঠানামা এবং জরুরি অপারেশন পরিচালনায় তারা দক্ষতা প্রদর্শন করেছে।”
নৌবাহিনী পরিচালিত চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেডের পরিচালক ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল বন্দর পরিচালনায় উন্নতমানের কার্যক্ষমতা এবং সময়মতো কাজ সম্পন্ন করা। প্রতিদিনের অপারেশনে স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা বজায় রেখে গ্রাহক সেবার মান উন্নয়ন আমরা প্রাধান্য দিয়েছি।”
তিনি আরও জানান, “নৌবাহিনী বাহিনীর সংহত প্রশিক্ষণ এবং কঠোরতা কাজে লাগিয়ে টার্মিনালের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো আধুনিক সরঞ্জামাদি ও তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে এই সফলতাকে টেকসই করতে আমরা কাজ করছি।”
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের প্রধান বন্দর হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের গতি বাড়ানো মানে দ্রুত ও সঠিক পণ্য সরবরাহ, যা ব্যবসায়ীদের জন্য সময় ও খরচ দুটোই কমায়।
অর্থনীতিবিদ ড. হাসান মুজতবা বলেন, “বন্দর পরিচালনার উন্নতি দেশের রপ্তানি-আমদানিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। দ্রুত ও কার্যকর বন্দর সেবা বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশকে উন্নত করবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান শক্তিশালী করবে।”
তিনি সতর্ক করেন, “তবে এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বন্দর ব্যবস্থাপনায় কোনো ধরনের ধীরগতি বা অনিয়ম দেশে লগ্নি ও বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই নিয়মিত মূল্যায়ন ও উন্নয়ন জরুরি।”
যদিও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে, তবুও এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বন্দরের আধুনিকায়ন, লজিস্টিকস অবকাঠামোর উন্নয়ন, এবং আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদান এখনো গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, “বন্দর ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির সংযুক্তি, যেমন স্বয়ংক্রিয় কনটেইনার ট্র্যাকিং সিস্টেম, ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন, এবং শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা, দেশের বন্দরের গতি ও সক্ষমতা দ্বিগুণ করতে পারে।”
এছাড়া, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে কার্যক্রম আরও গতিশীল ও সুষ্ঠু রাখা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমোরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় নৌবাহিনীর দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে গড়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণে লক্ষণীয় উন্নতি এসেছে, যা দেশের বন্দর কার্যক্রমের জন্য ইতিবাচক সংকেত।
সরকার, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং নৌবাহিনী একযোগে কাজ করে এই উন্নতিকে স্থায়ী ও টেকসই করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য আরও আধুনিকায়ন, দক্ষ মানবসম্পদ ও প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থনীতির গতি সুষ্ঠুভাবে বজায় রাখতে বন্দর ব্যবস্থাপনায় এমন সফলতা অব্যাহত রাখা এখন সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাবার্তা/এসজে