
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান সংস্কার ও কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে যে অসন্তোষ ও আন্দোলন হয়েছিল, সেটিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ দেওয়ার একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত ছিল বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।
রোববার (১৩ জুলাই) দুপুরে সচিবালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে এক আলাপকালে তিনি বলেন, “এনবিআরের অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, সেটিকে বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার চক্রান্ত হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল—সরকারকে অস্থির করে তোলা, রাজস্ব খাতে অচলাবস্থা সৃষ্টি করা এবং জাতীয় অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করা।”
তিনি আরও বলেন, “একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী কিছু কর্মকর্তা একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে সরকারবিরোধী পরিকল্পনা ও অবস্থান তৈরি করেছিলেন। সেখানে সরকারের নীতিমালা, কর্মকর্তাদের পদায়ন ও সংস্কার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য এবং সংগঠিত বিক্ষোভের কর্মসূচি চালানো হতো। এসব তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও রয়েছে।”
জ্বালানি উপদেষ্টা স্পষ্ট করে বলেন, “এনবিআরের কিছু অসন্তুষ্ট কর্মকর্তা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও সরকার বিষয়টিকে কঠোর হাতে দমন না করে আলোচনা ও ধৈর্যের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করেছে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের একাংশ সেই সুযোগকে ব্যবহার করে সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করে।”
উল্লেখ্য, এনবিআরের দীর্ঘদিনের অদক্ষতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যবসায়ী হয়রানি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের নেওয়া সংস্কার উদ্যোগের অংশ হিসেবে এনবিআরকে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগে ভাগ করা হয়েছে—রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব বাস্তবায়ন বিভাগ।
ফাওজুল কবির খান বলেন, “এই দুটি বিভাগ গঠনের পর সচিব পদে নিয়োগ নিয়ে এনবিআরের একটি অংশ অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং সংগঠিত আন্দোলনে নামে। তবে তারা এখন অনুধাবন করছে যে, এ ধরনের কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া এনবিআরের বর্তমান জটিলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।”
তিনি জানান, আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি ইতিমধ্যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছে। এতে ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন, আয়কর অ্যাসোসিয়েশন, এনবিআর কর্মকর্তারা, সংস্কার কমিশন এবং ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছেন।
আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য তুলে ধরে উপদেষ্টা বলেন, “ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দুই মাসের আন্দোলনের কারণে তারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রাজস্ব আদায়ে স্থবিরতা এসেছে, আমদানি-রপ্তানিতে ব্যাঘাত ঘটেছে, এবং নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। তারা এই সংস্কারকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং এনবিআরের নাম পরিবর্তনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট কর্মকর্তারা বলেছেন—রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগে ক্যাডার কর্মকর্তাদের উপযুক্তভাবে নিয়োগ দিলে তারা আপত্তি করবেন না। এমনকি তারা নিজেদের অবস্থান থেকে ক্ষমা প্রার্থনাও করেছেন। এই পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।”
উল্লেখ্য, এনবিআরের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান চলছে। উপদেষ্টা বলেন, “দুদক যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা অনুরোধ করেছেন যেন এই প্রক্রিয়ায় অত্যধিক কঠোরতা পরিহার করে সময় ও বাস্তবতা বিবেচনায় ধীরগতি অবলম্বন করা হয়।”
অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, “আমরা স্বীকার করি, অর্থনীতি এখনো প্রত্যাশিত স্থিতিতে পৌঁছেনি। তবে গত কয়েক মাসে পরিস্থিতি অনেকটা গতি পেয়েছে। সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ পরিকল্পনা, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম এবং ব্যবসায়িক পরিবেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা ইতিবাচক ফল দিচ্ছে।”
প্রসঙ্গত, গত ৩০ জুন সরকার এনবিআর সংস্কার ও রাজস্ব খাতকে অধিকতর কার্যকর করতে পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করে, যার মাধ্যমে নীতিগত ও প্রশাসনিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এই কমিটিতে আরও রয়েছেন—নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন; বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
এই কমিটি এখন মাঠপর্যায়ে রাজস্ব আদায়ের প্রকৃত চিত্র জানতে কাজ করছে এবং প্রত্যক্ষভাবে ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাদের মতামত যাচাই করছে। উপদেষ্টারা আশা প্রকাশ করেছেন, শিগগিরই রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্থায়ী শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
বাংলাবার্তা/এসজে