
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ওষুধ খাত একসময় ছিল কেবল ঘরোয়া চাহিদা মেটানোর সীমায় আবদ্ধ। তবে বিগত সাত বছরে দেশটি এই খাতের রপ্তানিতে যে বৈপ্লবিক অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষকদের নজর কেড়েছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ যেখানে প্রায় ১৪০টি দেশে ১০০ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি মূল্যের ওষুধ রপ্তানি করত, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সেটি দাঁড়িয়েছে ২১৩ মিলিয়ন ডলারে—অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ শতাংশ, আগের অর্থবছরের তুলনায়।
এই রপ্তানি প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে—নতুন বাজারে প্রবেশ, উদ্ভাবনী পণ্য সংযোজন, আধুনিক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ, দক্ষ জনবল ও ক্রমাগত নিয়ন্ত্রিত মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
সাত বছর আগেও বাংলাদেশি ওষুধ রপ্তানি হতো মাত্র ১৪০টি দেশে। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৬টি। বিশেষ করে সিআইএস (কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেটস) দেশগুলো—উজবেকিস্তান, কাজাখিস্তান, কিরগিজস্তান ইত্যাদি—বাংলাদেশি ওষুধের গুরুত্বপূর্ণ বাজারে রূপান্তরিত হচ্ছে।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস-এর প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এই প্রবৃদ্ধির মূল কারণ হলো, আমরা নতুন মলিকিউল এবং বিশেষায়িত ওষুধ তৈরি করছি। আগে যেসব ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি হতো, এখন তা দেশে উৎপাদিত হচ্ছে এবং বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিআইএস দেশগুলোয় ওষুধ রেজিস্ট্রেশনের নিয়ম সহজ হওয়ায় আমরা দ্রুত বাজার ধরতে পারছি। পাশাপাশি আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার সম্ভাব্য বাজারেও নজর দিচ্ছি।’
তবে শুধু নতুন বাজারে প্রবেশই নয়, প্রতিকূলতা মোকাবিলা করাও ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। ডলার বিনিময় হারের অস্থিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সরবরাহ চেইনে বিঘ্ন তৈরি করেছিল বড় প্রতিবন্ধকতা।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড-এর আন্তর্জাতিক বিপণন বিভাগের ব্যবস্থাপক ওয়াসিম হায়দার বলেন, ‘গত তিন বছর আমাদের জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবুও গত অর্থবছরে আমরা প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। এটা সম্ভব হয়েছে কারণ আমাদের শ্রমিক থেকে শুরু করে শীর্ষ কর্মকর্তারা সবাই একসঙ্গে কাজ করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা কেবল ব্যবসা নয়, এটা বাংলাদেশের সাফল্যের প্রতীক।’
ওষুধ রপ্তানির বাজার অন্যান্য রপ্তানি খাতের তুলনায় ভিন্ন। পোশাক শিল্পে যেমন পণ্যের অর্ডার ও সরবরাহের সময় কম, ফার্মাসিউটিক্যালসে একেকটি ওষুধ বাজারজাত করতে দুই থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে।
এই বাস্তবতা তুলে ধরে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস-এর নির্বাহী পরিচালক (মার্কেটিং) আরেফিন আহমেদ বলেন, ‘ফার্মাসিউটিক্যালস শিল্পে সফলতা রাতারাতি আসে না। রেজিস্ট্রেশন, মান যাচাই, গবেষণা এবং উৎপাদন—সবকিছুই সময়সাপেক্ষ। এজন্য প্রয়োজন হয় দূরদর্শী পরিকল্পনা ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত এক দশকে বাংলাদেশের ফার্মা কোম্পানিগুলো আধুনিক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করেছে, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাব তৈরি করেছে, দক্ষ বিজ্ঞানী নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানে ওষুধ উৎপাদন করছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন আর শুধু সাধারণ জেনেরিক ওষুধ রপ্তানিই লক্ষ্য নয়। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষায়িত থেরাপিউটিক সেগমেন্টে যেমন—অনকোলজি, কার্ডিওলজি, ডায়াবেটিস ও নিউরোলজির জন্যও ওষুধ তৈরি করছে।
বিএসসিআই (বাংলাদেশ স্পেশালাইজড কেমিক্যালস ইনিশিয়েটিভ)-এর জেষ্ঠ্য বিশ্লেষক ডা. ফারহানা ইমতিয়াজ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে হলে ওষুধে শুধু দাম কম হলেই হয় না, মানও নিশ্চিত করতে হয়। বাংলাদেশের ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অনেক বেশি রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্স মেনে চলে। এটি তাদেরকে উন্নত বিশ্বের বাজারে জায়গা করে দিচ্ছে।’
এতোসব ইতিবাচক অগ্রগতির মধ্যেও কিছু মৌলিক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। যেমন:
রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে—বিশ্বের অন্যান্য উদীয়মান দেশ, বিশেষত ভারত, চীন ও ভিয়েতনামও একই বাজারের জন্য লড়াই করছে।
জটিল রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া—বিশেষত ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে প্রবেশের জন্য কঠোর মান নিশ্চিত করতে হয়।
টেকসই কাঁচামালের উৎস—কাঁচামালের জন্য এখনো বাংলাদেশ অনেকাংশে আমদানি নির্ভর।
বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস শিল্প এখন কেবল দেশীয় চাহিদা মেটাচ্ছে না, বরং বিশ্ববাজারে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দশকে ওষুধ রপ্তানি আয় এক বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা, নীতিগত স্থিতিশীলতা, গবেষণায় বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক নিয়মের কঠোর অনুসরণ।
বাংলাদেশের জন্য ওষুধ শিল্প এখন শুধু অর্থনীতির চালিকাশক্তি নয়, বরং বৈশ্বিক বাজারে এক আস্থার নাম হয়ে উঠছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ