
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আহরণ পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের জুন মাসে এনবিআর যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কম। এনবিআরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের জুনে আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা, যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুনে আদায় হয়েছিল ৫৩ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে জুন মাসের রাজস্ব আয় কমে গেছে ৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা।
এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই পরিস্থিতিকে অস্বাভাবিক ও উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করছেন। তাঁদের মতে, সাধারণত জুন মাসে অর্থবছরের সমাপ্তির কারণে আমদানি-রপ্তানি, উৎপাদন ও পণ্য বিক্রির হিসাব চূড়ান্ত করতে গিয়ে রাজস্ব আহরণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে থাকে। তবে এবার পরিস্থিতি ছিল ব্যতিক্রম। গত মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এনবিআর বিলুপ্তির প্রতিবাদে দেশব্যাপী রাজস্ব কর্মকর্তাদের আন্দোলন শুরু হয়, যা প্রায় দেড় মাস ধরে চলতে থাকে। এতে মাঠ পর্যায়ে রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে আনা হয় ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এনবিআরের প্রাপ্ত আয় দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকায়, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৯২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ কম। যদিও আগের অর্থবছরের তুলনায় রাজস্ব আয় সামান্য বেড়েছে—প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ২৩ শতাংশ।
আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং কাস্টমস (শুল্ক) খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ীও বড় ধরনের ঘাটতি দেখা গেছে। আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র ১ লাখ ২৯ হাজার ৯০ কোটি টাকা—যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৪২ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা কম। ভ্যাট খাতে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা, অথচ আদায় হয়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এতে করে ভ্যাট খাতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। আয়কর ও ভ্যাট—উভয় খাতে আয় কম হলেও তুলনামূলকভাবে ভ্যাট আদায় এগিয়ে আছে বলে জানিয়েছে এনবিআর।
শুল্ক বা কাস্টমস খাতে আদায়কৃত রাজস্বের চিত্রও হতাশাজনক। চলতি অর্থবছরে এ খাতে আদায় হয়েছে মাত্র ১ লাখ ১৯৮ কোটি টাকা, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ কাস্টমস খাতে ঘাটতির পরিমাণ ২০ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।
তবে এনবিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে কর, ভ্যাট ও শুল্ক আদায়ে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ইতিবাচক। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় শুল্ক খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ০.৩৩ শতাংশ, ভ্যাটে ৩.০১ শতাংশ এবং আয়করে ২.৮৭ শতাংশ। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার ঘাটতি পূরণ করতে পারেনি।
আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আদায় কমেছে বলে স্বীকার করেছেন এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “প্রতি বছর জুন মাসে আমরা প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করি। এবার আন্দোলনের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে, আমদানি-রপ্তানি কমে যায়, ক্লিয়ারিং প্রক্রিয়া ধীর হয়। ফলে আদায়ও ব্যাপকভাবে কমে গেছে।”
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১২ মে সরকার অধ্যাদেশ জারি করে এনবিআরকে ভেঙে দুটি পৃথক বিভাগে—রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব প্রশাসন বিভাগে রূপান্তরের ঘোষণা দেয়। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এনবিআরের কর্মচারী ও কর্মকর্তারা একযোগে আন্দোলনে নামে। ২৯ মে পর্যন্ত চলা এই কর্মবিরতির প্রভাবে জুনের রাজস্ব সংগ্রহ কার্যত ভেঙে পড়ে।
এনবিআর সূত্র বলছে, চলমান সংকটের ফলে সরকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আরও চাপের মুখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পেতে যেসব শর্ত পূরণ করতে হবে, তার একটি ছিল রাজস্ব আহরণে দৃঢ়তা এবং কাঠামোগত সংস্কার। কিন্তু বর্তমান রাজস্ব ঘাটতি সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব ঘাটতির এই ধারা অব্যাহত থাকলে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি), ভর্তুকি, সামাজিক নিরাপত্তা খাতসহ নানা ব্যয়ের জন্য দেশীয় উৎস থেকে অর্থ সংস্থান কঠিন হয়ে পড়বে। এর ফলে আরও বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভরতা বাড়তে পারে।
চূড়ান্ত হিসাব এখনো প্রকাশিত না হলেও এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা মনে করছেন, কিছু নিরীক্ষা ও দীর্ঘমেয়াদি পাওনা অন্তর্ভুক্ত হলে সামান্য হারে আয় বাড়তে পারে। তবে তা লক্ষ্যমাত্রার ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট হবে না বলেই ধারণা বিশ্লেষকদের।
সরকার ও এনবিআরের জন্য এই পরিস্থিতি একদিকে যেমন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে অর্থনৈতিক কৌশল নির্ধারণে বড় ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বলে মনে করছেন কর বিশেষজ্ঞরা। এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কার ও কর্মপরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা ছাড়া রাজস্ব ঘাটতি থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ