
ছবি: সংগৃহীত
গোপালগঞ্জ শহরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ ঘিরে চরম উত্তেজনা ও সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছে। বুধবার (১৬ জুলাই) দুপুর থেকে শুরু হওয়া একাধিক দফার হামলা ও পাল্টা-সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে উঠে শহরের কেন্দ্রীয় অংশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিকেলে গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসন শহরের কিছু এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে।
এই ঘটনার সূত্রপাত হয় বেলা পৌনে তিনটার দিকে শহরের পৌর পার্ক এলাকায় এনসিপির সমাবেশ মঞ্চে হামলার মাধ্যমে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত ২০০ থেকে ৩০০ জনের একটি দল হঠাৎ করেই মঞ্চ এলাকায় প্রবেশ করে ভাঙচুর শুরু করে। তারা মঞ্চের চেয়ার ও অন্যান্য আসবাবপত্র ছিঁড়ে ফেলে, ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে এবং এনসিপি নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয়।
হামলার সময় উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা প্রথমে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হন এবং নিকটবর্তী আদালত এলাকায় সরে যান। এনসিপির কর্মীরাও মঞ্চ ছেড়ে দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের চেষ্টা করেন। এনসিপির দাবি অনুযায়ী, হামলাকারীরা সবাই আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিলেন।
সমাবেশস্থলে তখন সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনা ও পুলিশ সদস্যরা সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে মঞ্চ এলাকা প্রায় পুরোপুরি দখল করে নেয় হামলাকারীরা। পরে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আগেই প্রশাসনকে জানিয়েছিলাম, কিছু একটা ঘটতে পারে। তারা বলেছিলেন, ‘সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে’। কিন্তু আমরা মঞ্চে গিয়ে দেখি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র।”
নাসীরুদ্দীনের অভিযোগ, হামলার সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনী সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি। তিনি বলেন, “তারা নিষ্ক্রিয় ছিল। আমরা ঘিরে ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ এক দিক দিয়ে হামলা হলো। মঞ্চে অবস্থানরত অনেক নেতাকর্মী আহত হন, কিছুজন দৌড়ে পালাতে গিয়ে পড়ে যান। তারপরই আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করি।”
এদিকে হামলার কিছুক্ষণ পর জেলা পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি পরিদর্শন করেন। তখন এনসিপির নেতাকর্মীরা পুলিশের সহায়তায় সংঘটিত হামলাকারীদের ধাওয়া দিলে তারা দ্রুত সরে যায়। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে বিকেল চারটার দিকে এনসিপি পুনরায় সমাবেশ শুরু করে, যদিও উপস্থিতি ছিল অনেক কম।
সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, “পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে জেলা প্রশাসক মো. কামরুজ্জামান পৌর পার্ক ও আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছেন। জনস্বার্থে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই আদেশ বলবৎ থাকবে।”
গোপালগঞ্জে এই ঘটনা রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে এনসিপির সমাবেশে হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং এর পেছনে ক্ষমতাসীন দলের পরিকল্পিত ভূমিকা আছে বলেও অভিযোগ করেছেন।
এনসিপির নেতারা জানান, গোপালগঞ্জে দলটির প্রথম বড় ধরনের সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। সেই প্রস্তুতি নিয়েই তারা মঞ্চ তৈরি ও কর্মী সমাবেশ করছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলার মাধ্যমে সেটি বানচাল করে দেওয়া হয়েছে।
গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রাত পর্যন্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টহল জোরদার করা হয়। ১৪৪ ধারার আওতায় পাঁচজনের বেশি ব্যক্তি একত্রে জমায়েত হতে পারবে না এবং কোনো সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ থাকবে।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে গোপালগঞ্জে এনসিপির মতো ছোট দলগুলোর সক্রিয়তা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তদন্তের অংশ হিসেবে প্রশাসন সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করছে। জেলা প্রশাসক জানান, দোষীদের শনাক্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এনসিপি নেতারা বলছেন, যদি হামলাকারীরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী হন, তাহলে প্রশাসন আদৌ পদক্ষেপ নেবে কি না, তা নিয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে।
এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি, তবে এনসিপি কেন্দ্র থেকে মামলা করার প্রস্তুতি চলছে বলেও জানা গেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ