
ছবি: সংগৃহীত
আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযুক্তি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে স্যাটেলাইট পর্যন্ত, প্রতিটি উদ্ভাবন মানবজীবনকে সহজ, দ্রুত ও কার্যকর করার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি। তবে প্রযুক্তির এই অসীম সম্ভাবনার পেছনে লুকিয়ে থাকে এক বড় ঝুঁকি—মানব ভুল, ত্রুটিপূর্ণ প্রোগ্রামিং বা কুযোগে প্রযুক্তি কখনো বিপজ্জনক রূপ ধারণ করে। বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া কিছু চাঞ্চল্যকর দুর্ঘটনা এই বাস্তবতাটিকে স্পষ্ট করে। আজকের প্রতিবেদনে আমরা বিশ্লেষণ করব সেই ঘটনাগুলো, যেগুলো প্রযুক্তির ভুল ব্যবহারের ফলে ঘটেছিল এবং যা আমাদের জন্য এক সতর্কবার্তা।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পাতায় প্রায়ই দেখা যায় যন্ত্রগুলি মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ‘টার্মিনেটর’, ‘আই, রোবট’ বা ‘ম্যাট্রিক্স’-এর মতো চলচ্চিত্রে প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিপদের কারণ হয়। বাস্তব জীবনে যদিও সেসব গল্প কল্পকাহিনী, প্রযুক্তির সহায়ক ভূমিকা যেমন অস্বীকার করার নয়, তেমনি এর ভয়াবহ প্রভাবও চোখ অন্দরে দেখা যায়। প্রযুক্তির ওপর অতি নির্ভরতা, অবহেলা কিংবা মানুষের ভুল ব্যবহার প্রায়ই বিপর্যয়ের জন্ম দেয়।
১. অ্যামাজনের ‘অ্যালেক্সা’র খেলা, বড় বিপদ এড়ানো গেল মাত্র
২০২১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে, যা প্রযুক্তির অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাবের এক নজির। মহামারির কঠিন সময়ে এক মা ও তার শিশু ‘অ্যালেক্সা’ ডিজিটাল সহকারীর কাছে একটি চ্যালেঞ্জ স্বরূপ অনুরোধ করেন। তবে ‘অ্যালেক্সা’ তাদের অনুরোধের উত্তরে এমন কিছু বলল যা শিশুর জন্য মারাত্মক বিপদের সম্ভাবনা তৈরি করেছিল—চার্জারের আউটলেটে অর্ধেক ঢুকিয়ে তাতে পয়সা স্পর্শ করার পরামর্শ! দ্রুত মা বিষয়টি বুঝে শিশুকে রক্ষা করতে সক্ষম হন। এ ঘটনাটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, ভুল প্রোগ্রামিং বা অপ্রত্যাশিত নির্দেশনার কারণে তা ভয়ঙ্কর হতে পারে।
২. ইতিহাসের প্রথম রোবটজনিত প্রাণহানি: ফোর্ডের ভয়াবহ ঘটনা
১৯৭৯ সালে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে এক ভয়ঙ্কর ঘটনা যুক্ত হয়, যা রোবটের সঙ্গে মানুষের প্রথম প্রাণঘাতী সংঘর্ষ হিসেবে ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। ফোর্ড মোটর কোম্পানির কর্মী রবার্ট উইলিয়ামস তার কাজের ফাঁকে এক রোবটের সঙ্গে কাজ করছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, রোবটের বাহু তার উপর আঘাত হানে এবং ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। এটি প্রমাণ করে যে, মানবিক সুরক্ষা ব্যবস্থার ঘাটতি কিংবা প্রযুক্তির অব্যবস্থাপনার জন্য জীবনহানি হতে পারে।
৩. কানাডার কুয়াশার রাতে জিপিএসের ফাঁদ
২০১৬ সালে কানাডার এক নারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার শিখর। ঘন কুয়াশা ও ঝড়ের রাতে তিনি গাড়ি চালানোর সময় পুরোপুরি জিপিএসের ওপর নির্ভর করেন। যন্ত্রের ভুল নির্দেশনার কারণে গাড়িটি হ্রদের পানিতে পড়ে যায়। ভাগ্যক্রমে জানালা ভেঙে বের হয়ে বাঁচতে সক্ষম হন তিনি। এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রযুক্তির ওপর অতি নির্ভরতা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, বিশেষ করে প্রকৃতি এবং পরিস্থিতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে।
৪. যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণ ভিডিওর ভয়াবহ ভুল
১৯৭৯ সালের আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়, যেখানে একটি প্রশিক্ষণ ভিডিও ভুলক্রমে মূল সিস্টেমে চালু হয়ে যায়। মুহূর্তেই সতর্ক সংকেত বাজতে শুরু করে, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের হুমকি ধরা পড়ে। প্রেসিডেন্টকে পালটা হামলার নির্দেশ দেওয়ার আগেই বোঝা যায় এটি একটি ভুল। সুতরাং প্রযুক্তি এমন জায়গায় ভুল করলে বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এ ঘটনায় বিশ্ববাসী একবারে বুঝে যায়, প্রযুক্তি কতটা সংকটজনক রূপ নিতে পারে।
উপরোক্ত ঘটনা গুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়; এরা আমাদের জন্য এক গভীর শিক্ষা। প্রযুক্তির সফল ব্যবহার নির্ভর করে মানুষের সচেতনতা, দক্ষতা ও সতর্কতার ওপর। ভুল ক্লিক, অবহেলা বা অপব্যবহার প্রযুক্তিকে ঘাতক হাতিয়ার করে তুলতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে যেমন হ্যাকিং, তথ্য চুরিসহ ডিজিটাল ঝুঁকিগুলো বেড়ে গেছে, তেমনি প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণে আমাদের সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
আজকের যুগে প্রযুক্তি যেন তলোয়ারের মতো। এটি যেভাবে ব্যবহার করা হবে, তার উপর নির্ভর করবে আমাদের সমাজের নিরাপত্তা ও শান্তি। প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণের পাশাপাশি তার ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে অবগত থেকে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণই আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
ডিজিটাল সহায়ক যন্ত্রগুলোতে সঠিক প্রোগ্রামিং ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন।
রোবট এবং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানবিক সুরক্ষা বিধানের কঠোর প্রয়োগ।
জিপিএস ও নেভিগেশন যন্ত্রের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা ও পরিমিত ব্যবহার।
প্রতিরক্ষা ও গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেমে প্রযুক্তির পরীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা।
প্রযুক্তি মানবজাতির সেরা অগ্রগতি হলেও, তার ভুল ব্যবহার বা অবহেলা নিয়ে আসতে পারে ভয়ংকর বিপদ। সুতরাং প্রযুক্তিকে শুধু উন্নতির হাতিয়ার হিসেবে নয়, বরং সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসেবেও দেখতে হবে। মানুষের সচেতনতা, দায়িত্ববোধ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া প্রযুক্তি ভয়ঙ্কর অস্ত্রে পরিণত হতে পারে।
আমাদের সকলেরই উচিত প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হলে সে যেন মানবকল্যাণের দিশারী হয়, বিপদের কারণ নয়।
সূত্র: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন, প্রযুক্তি বিশ্লেষণ ও সংবাদ সংস্থার প্রকাশনা
বাংলাবার্তা/এমএইচ