
ছবি: সংগৃহীত
দেশের মুদ্রাবাজারে দীর্ঘদিন ধরেই দেখা যাওয়া অস্থিরতা ও ডলারের দর নিয়ে ঊর্ধ্বগতি প্রবণতার মধ্যে ঢাল ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত দুই দিনে বিপুল পরিমাণ ডলার ক্রয় করেছে, যা মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ৪৮ কোটি মার্কিন ডলার কিনেছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করেছে এবং ডলারের দর কমতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর পর থেকে ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক নিয়মাবলী মেনে নিজেদের মধ্যে ডলার লেনদেন করছে। এতে করে কয়েকমাস ধরে চলমান অস্থিরতার অবসান ঘটেছে এবং মুদ্রাবাজারে স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করেছে। বিশেষত প্রবাসী আয় থেকে আসা রেমিট্যান্সের ডলার ক্রয় এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সংযত ও কার্যকর হচ্ছে। রেমিট্যান্সকারীরা তুলনামূলক কম দামে ডলার বিক্রি করছেন, যার ফলে আমদানিকারকরা সুলভ দামে বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছেন।
এই অতিরিক্ত ও উদ্বৃত্ত ডলারই বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে ক্রয় করছে, যা বাজারকে আরও স্থিতিশীল করতে সহায়তা করছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা মনে করছেন, এখন সময় এসেছে আমদানি বিধিনিষেধ ও বিলাসবহুল পণ্যে আরোপিত অতিরিক্ত শর্তসমূহ তুলে নেওয়ার। এর মাধ্যমে আমদানি বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের বাণিজ্যে গতিশীলতা ফেরানো সম্ভব হবে।
গত কয়েকদিন ধারাবাহিক দরপতনের পর গতকাল মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) হঠাৎ ডলারের দর বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ১২১ টাকা ৫০ পয়সা এবং সর্বনিম্ন দর ছিল ১২০ টাকা ৮০ পয়সা। এর আগের দিন একই দর ছিল যথাক্রমে ১২০ দশমিক ১০ ও ১১৯ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ মাত্র একদিনেই ডলারের গড় বিক্রয়মূল্য প্রায় ১ টাকা ৪০ পয়সা বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ওইদিন ২২টি ব্যাংকের কাছ থেকে ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলার কিনেছে, যার প্রতি ডলারের ক্রয়মূল্য ছিল ১২১ টাকা ৫০ পয়সা। এর আগে গত রোববার ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার কেনা হয়।
দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ ছিল ডলারের উচ্চমূল্য। তবে বর্তমানে ডলারের দর কমে আসায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্যও রয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, আর এই প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বাজারমূল্যকে ‘স্বাভাবিক’ পর্যায়ে রাখতে ব্যাপক মনোযোগ দিচ্ছে।
বর্তমানে ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে ১২১ টাকায়, যা এক মাস আগেও ছিল প্রায় ১২৩ টাকার ওপরে। যদিও ডলারের দর কমেছে, দেশের প্রবাসী আয় বাড়ছে, তবে বাণিজ্য ও আমদানিতে এখনও গতি দেখা যাচ্ছে না। এলসি খোলার হার কম থাকার কারণে ব্যাংকগুলোর ডলারের চাহিদাও কমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “বকেয়া আমদানি দায় পরিশোধের কারণে বাজারে ডলারের চাহিদা কমেছে। একই সঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় ডলার সংকট কাটাতে সাহায্য করেছে। তবে ডলারের দর কমে গেলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই আমরা বাজার থেকে ডলার সংগ্রহের মাধ্যমে এই ঝুঁকি মোকাবিলা করছি।”
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সিদ্দিকী বলেন, “মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগ সময়োপযোগী। তবে আমদানিতে যদি বিধিনিষেধ শিথিল হয়, তা হলে বাজারে আরও গতি আসবে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল হবে এবং বাজারের অস্থিরতা কমবে।”
অন্যদিকে বাণিজ্য বিশ্লেষক রুমি আক্তার বলেন, “বর্তমানে ডলারের দর কমে আসায় আমদানির ব্যয় কমে যাবে, যা পণ্যের বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। তবে দেশে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক না হলে ডলার চাহিদা পুরোপুরি বৃদ্ধি পাবে না।”
বর্তমানে দেশের মুদ্রাবাজারে ডলার সরবরাহ বেড়ে আসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কেনায় মনোযোগ বাড়িয়েছে। এ উদ্যোগ বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হচ্ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমবে বলে আশাবাদী অর্থনীতিবিদরা।
তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতা কাটাতে আমদানিতে শিথিলতা জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সরকারের উচিত দ্রুত আমদানি বিধিনিষেধ পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা, যাতে আমদানির চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং দেশের অর্থনীতি গতিশীল হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পদক্ষেপ মুদ্রাবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমদানি শিথিল হলে বাজারে আরও গতি আসবে এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও উন্নতির পথে যাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ