
ছবি: সংগৃহীত
নিবন্ধন স্থগিতের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের নির্বাচনী প্রতীক ‘নৌকা’ অবশেষে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওয়েবসাইট থেকেও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বুধবার (১৬ জুলাই) সকালে ইসির ওয়েবসাইটে দেখা যায়, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের তালিকায় আওয়ামী লীগ এখনো ছয় নম্বরে থাকলেও তার নামের পাশে আর 'নৌকা' প্রতীকটি নেই। যদিও এর আগের দিন মঙ্গলবার পর্যন্ত ওয়েবসাইটে দলটির নামের পাশেই প্রতীক হিসেবে ‘নৌকা’ দেখা যাচ্ছিল।
এই প্রতীক অপসারণ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ভেতরে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার ঝড় বয়ে গেছে। কারণ, মাত্র কিছুদিন আগেই নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ (১২ জুলাই) সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, “নিবন্ধন স্থগিত হলেও প্রতীক নিষিদ্ধ হয় না। প্রতীক বরাদ্দের মালিক নির্বাচন কমিশন। কোনো দল বাতিল হলেও সেই প্রতীক নির্বাচন কমিশনের মালিকানায় থেকে যাবে এবং ভবিষ্যতে অন্য কোনো দলের জন্য তা বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে।”
কিন্তু বাস্তবে মাত্র চার দিনের ব্যবধানে কমিশনের অবস্থানে যে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে, তা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন ইসির ওয়েবসাইটে ‘নৌকা’ প্রতীকটি হঠাৎ করেই আর দেখা যায় না।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিবালয়ের সিস্টেম ম্যানেজার মো. রফিকুল হক বলেন, “ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে প্রতীকটি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।” তবে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি, বা রাজনৈতিক কোনো চাপ ছিল কি না, সে সম্পর্কেও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এমন সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনৈতিক চাপের বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। বিশেষ করে মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার একটি ফেসবুক পোস্টে ইসির বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়েন। তিনি লিখেছেন, “অভিশপ্ত নৌকা মার্কাটাকে আপনারা কোন বিবেচনায় আবার শিডিউলভুক্ত করতে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠালেন?”
এর আগে, গত ১২ জুলাই নির্বাচন কমিশনে একটি বৈঠক করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একটি প্রতিনিধি দল। বৈঠকে তারা আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীককে ইসির তালিকা থেকে বাতিলের দাবি তোলে। তাদের যুক্তি ছিল, দলটির নিবন্ধন স্থগিত হওয়ায় এই প্রতীকের কোনো রাজনৈতিক বৈধতা আর নেই।
এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই প্রতীক সরানোর সিদ্ধান্ত এসেছে কি না—এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। অনেকে মনে করছেন, নির্বাচনী মাঠে প্রতীক নিয়ে বিভ্রান্তি রোধ করতে এবং সাংগঠনিক বিতর্ক কমাতে কমিশন এই পদক্ষেপ নিয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, রাজনৈতিক চাপ ও জনমতের প্রতিক্রিয়ার ফলেই ইসি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেননি। তবে দলটির কয়েকজন তরুণ নেতা ও সংসদ সদস্য সামাজিক মাধ্যমে ইসির সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যা দিয়েছেন।
তবে ইসি’র আইনগত অবস্থান কিছুটা বিভ্রান্তিকর বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ, একটি দলকে নিবন্ধন না থাকলে বা নিবন্ধন স্থগিত থাকলে সাধারণত তার নির্বাচনী প্রতীক ব্যবহারের সুযোগ থাকেনা। তবে কমিশনের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রতীক বরাদ্দ করে থাকলেও সেটির মালিকানা থাকে কমিশনের কাছে। এতে প্রতীক বাতিলের জন্য দল বাতিল হওয়া আবশ্যক নয়।
বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫০টি। নির্বাচন কমিশন এ পর্যন্ত মোট ৬৯টি প্রতীক অনুমোদন দিয়েছে। তবে ইসি সম্প্রতি এই সংখ্যা বাড়িয়ে ১১৫টি করার প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। নৌকা প্রতীক এই বাড়তি তালিকার মধ্যে থাকছে কি না—সে ব্যাপারেও কমিশন স্পষ্ট কোনো বক্তব্য দেয়নি।
এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কোনো প্রতীক তুলে নেওয়া বা তালিকাভুক্ত রাখা—এই সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থাকতে হবে, তা না হলে কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘নৌকা’ প্রতীক ঘিরে এই বিতর্ক শুধু একটি প্রতীক নিয়ে নয়—এটি রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রতীকগত পরিচিতি এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দখলের প্রতীকী লড়াই বলেই অনেকে মনে করছেন। এখন দেখার বিষয়, নির্বাচন কমিশন এই বিতর্ককে কীভাবে সামাল দেয় এবং ভবিষ্যতে প্রতীক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কী ধরনের নীতিমালা গ্রহণ করে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ