
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে আরও পাঁচটি দেশে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যুক্তরাষ্ট্র, ওমান, দক্ষিণ আফ্রিকা, জর্ডান এবং মালদ্বীপ—এই পাঁচটি দেশে নতুন করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও এনআইডি সেবা চালুর অনুমোদন দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্য দিয়ে প্রবাসীদের বহু বছরের প্রতীক্ষিত দাবি পূরণের পথে আরেকটি ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ সরকার।
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) নির্বাচন কমিশনের এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) এএএম হুমায়ুন কবীর নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে বলেন, “প্রবাসীদের মধ্যে ভোটার হতে আগ্রহ রয়েছে অনেক। আমরা ইতোমধ্যে ৯টি দেশে ১৬টি মিশন অফিসে এ সেবা দিচ্ছি। এবার আরও পাঁচটি দেশের অনুমোদন পেলাম। এতে করে আমাদের লক্ষ্য আরও বিস্তৃত হবে।”
তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলস, ওয়াশিংটনসহ যেসব শহরে বাংলাদেশ মিশন অফিস রয়েছে, সেখানেই এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রম চালু করা হবে। এর আগে শুধুমাত্র নিউইয়র্কে পরীক্ষামূলকভাবে সীমিত পরিসরে এনআইডি কার্যক্রম চালু ছিল।
নতুন পাঁচটি দেশের মধ্যে ওমান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জর্ডান গুরুত্বপূর্ণ শ্রম বাজার হওয়ায় সেখানে প্রবাসীদের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। মালদ্বীপে সম্প্রতি বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
হুমায়ুন কবীর জানান, নতুন দেশগুলোতে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরুর জন্য ইতোমধ্যে কারিগরি প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পাঠানো, জনবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, সফটওয়্যার ইন্টিগ্রেশন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। “এগুলো আমরা দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি। কিছু দেশে পাবলিক আইপি ও অন্যান্য টেকনিক্যাল বিষয় বিলম্ব করছে, তবে শিগগিরই কার্যক্রম শুরু হবে,” বলেন তিনি।
বর্তমানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, ইতালি, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার ১৬টি মিশন অফিসে এনআইডি ও ভোটার নিবন্ধনের সেবা চালু রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের বৃহৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী, ধাপে ধাপে ৪০টি দেশে প্রবাসী এনআইডি কার্যক্রম চালুর লক্ষ্য রয়েছে। এর অংশ হিসেবেই প্রতিনিয়ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের অনুমোদন ও কারিগরি সহায়তার ভিত্তিতে কাজ এগিয়ে চলছে।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের (NID) তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ৯টি দেশে মোট আবেদন জমা পড়েছে ৪৮,০৮০ জনের, যাদের মধ্যে ২৯,৬৪৬ জন আঙুলের ছাপ দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন। ইতোমধ্যে ১৭,৩৬৭ জন ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবিটি প্রায় দুই দশক ধরে চলমান। ২০০৭-০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন শুরু হলে থেকেই প্রবাসীদের এই দাবিটি জোরালোভাবে উঠে আসে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কাজটি বারবার স্থবির হয়ে পড়ে।
২০১৯ সালের নভেম্বরে তৎকালীন কমিশনের অধীনে মালয়েশিয়ায় প্রথম অনলাইন ভিত্তিক এনআইডি সেবা চালু করা হলেও কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সেই উদ্যোগ থেমে যায়। পরবর্তীতে ২০২৩ সালে কাজ আবার শুরু হলেও ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কার্যক্রম ফের বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন, যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রবাসীদের ভোটার অন্তর্ভুক্তিতে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এনআইডি উইংয়ের পক্ষ থেকে একাধিক মিশন সফর, কারিগরি দল পাঠানো এবং সফটওয়্যার আপগ্রেড করা হয়েছে।
হুমায়ুন কবীর বলেন, “প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা কেবল রেমিট্যান্স প্রেরণ করেন না, বরং দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনেও সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারেন। তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের পরিপূর্ণতার অংশ।”
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবাসীদের ভোটার অন্তর্ভুক্তি হলে নির্বাচন আরও অংশগ্রহণমূলক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হবে। এটি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার দিকেও একটি বড় অগ্রগতি। তবে তারা সতর্ক করছেন, সেবার মান, ডাটার নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা—এই তিনটি বিষয় নিশ্চিতে কমিশনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
দেশের বাইরে থাকা প্রায় এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার পথে একধাপ এগিয়ে গেল নির্বাচন কমিশন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পাঁচ নতুন দেশে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের এই ডিজিটাল বন্ধন দেশের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে বলে প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
একটি আধুনিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রযুক্তিনির্ভর নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ার পথে এটি হতে পারে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ