
ছবি: সংগৃহীত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর—যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করেন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে। এই বন্দরের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরেই নানা পন্থায় চোরাচালান হয়ে আসছিল স্বর্ণ, মোবাইল, মাদকসহ বিভিন্ন মূল্যবান পণ্য। এবার এই চোরাচালান রোধে কঠোর অবস্থানে গেছে ঢাকা কাস্টমস হাউস। ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ভিত্তিতে বিমানবন্দরে চোরাচালান রোধে এবং যাত্রীসেবায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
১৫ জুলাই (মঙ্গলবার) দুপুরে ঢাকা কাস্টমস হাউসের কনফারেন্স রুমে এক ব্রিফিংয়ে কাস্টমস কমিশনার মুহাম্মদ জাকির হোসেন জানান, বিমানবন্দরে চোরাচালান এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, এটি একটি জাতীয় সমস্যা। তবে এ সমস্যা দমনে তারা কোনো ধরনের ছাড় দিচ্ছেন না। আধুনিক প্রযুক্তি, গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে নিবিড় সমন্বয় এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)-এর ব্যবহার—এই ত্রিমাত্রিক কৌশলে তারা এখন অনেক বেশি কার্যকরভাবে চোরাচালান প্রতিরোধ করতে পারছেন।
তিনি বলেন, “আমরা আগেই জানার চেষ্টা করছি কে কখন কোন ফ্লাইটে আসছে, তার ব্যাগেজে কী থাকতে পারে, তার ভ্রমণ ইতিহাস কী, আগেও তার নাম কোনো সন্দেহের তালিকায় ছিল কি না। এসব বিশ্লেষণ করা হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভরভাবে। স্ক্যানার দিয়ে পার হলেও সন্দেহভাজন যাত্রী নজরদারির মধ্যে থাকেন।”
চোরাচালানকারীদের শনাক্তে এখন আর শুধু চোখ-কান বা সন্দেহের ওপর ভরসা করছে না কাস্টমস। তারা ব্যবহার করছে এডভান্স কার্গো ইনফরমেশন (ACI) প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে যাত্রীর ডেটা আগেই সংগ্রহ করে সেটি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ডুবাইসহ বিভিন্ন ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে আগত যাত্রীদের তথ্য সংগ্রহ করে AI অ্যানালিটিকসের মাধ্যমে যাচাই করে আগে থেকেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে জানানো হচ্ছে।
ফলে, যাত্রী বিমান থেকে নামার আগেই গোয়েন্দারা প্রস্তুত থাকছেন। সন্দেহভাজন যাত্রীকে গ্রেপ্তার কিংবা অনুসন্ধানের জন্য ঘিরে ফেলা হচ্ছে বিমানবন্দর। আর এতে করে ধরা পড়ছে বড় বড় চালান—স্বর্ণ, সিগারেট, ইলেকট্রনিকস, এমনকি কূটনৈতিক তকমা ব্যবহার করা পণ্যও।
কমিশনার জানান, যাত্রী ব্যাগেজ যাচাইয়ের জন্য ইতোমধ্যে আধুনিক স্ক্যানার বসানো হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রী শনাক্ত করতে আগাম তথ্য বিশ্লেষণের ব্যবস্থা চালু হয়েছে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যাতে রাত-দিন সমানভাবে মনিটরিং করা যায়। এ ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে নিজ বিভাগের ভেতরেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যারা চোরাচালান সংশ্লিষ্টতায় সন্দেহভাজন ছিলেন।
তিনি বলেন, “শুধু যাত্রীর ব্যাগ না, কুরিয়ার সার্ভিস, কাস্টমস ক্লিয়ারিং এজেন্ট, এমনকি বিমানবন্দরে কর্মরত কিছু অসাধু কর্মীর সঙ্গে গোপন যোগসাজশেও চোরাচালান হয়—তাদেরও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।”
সম্প্রতি এমনও দেখা গেছে, ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট, কুরিয়ার সার্ভিস এমনকি কূটনৈতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করেও স্বর্ণ ও অন্যান্য পণ্য চোরাচালানের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এসব অপচেষ্টা রোধে কাস্টমস, এনএসআই, এপিবিএন ও অন্যান্য সংস্থার সমন্বিত তৎপরতায় বড় সাফল্য এসেছে।
গত এক বছরে শুধু শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেই প্রায় ১৭০ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকার বেশি। এই সাফল্য শুধু তৎপরতার ফল নয়, এটি কাস্টমসের আধুনিকায়ন, তথ্যভিত্তিক কৌশল এবং আন্তঃসংস্থার সমন্বয়ের ফল বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা কাস্টমস হাউস জানিয়েছে, ভবিষ্যতে স্ক্যানিং যন্ত্রপাতিকে আরও আধুনিক করা হবে, ব্লকচেইনভিত্তিক ডেটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করা হবে এবং AI অ্যানালিটিকস ব্যবহারের পরিধি বাড়ানো হবে। উদ্দেশ্য একটাই—বিমানবন্দর হয়ে চোরাচালান পুরোপুরি নির্মূল করা।
কাস্টমস কমিশনার জাকির হোসেন স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “আমাদের লক্ষ্য খুবই স্পষ্ট—শাহজালাল বিমানবন্দরকে চোরাচালানমুক্ত করা। যারা নিয়ম মানবেন, তাদের কোনো ভয়ের কারণ নেই। তবে যারা নিয়মভঙ্গ করে অবৈধ পথে পণ্য আনতে চাইবেন, তাদের জন্য কড়া ব্যবস্থা অপেক্ষা করছে।”
এই কড়া বার্তা একদিকে যেমন চোরাকারবারীদের জন্য সতর্কবার্তা, তেমনি সাধারণ যাত্রীদের জন্য স্বস্তির কারণ—এমনটাই বলছেন বিমানবন্দরের দায়িত্বশীলরা। ঢাকা কাস্টমস হাউসের এই যুগোপযোগী পদক্ষেপ একে কেবল কাস্টমস সংস্কার নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার একটি রূপরেখা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এসজে