
ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত পটুয়াখালীর কলাপাড়ার পায়রা সমুদ্রবন্দর দেশের জন্য এক স্বপ্নের মতো। প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এই বন্দরের কাজ এখন পর্যন্ত ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ২০২৬ সালের জুলাই মাস থেকে পূর্ণমাত্রায় অপারেশনাল হওয়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে পায়রা বন্দরের উন্নয়ন প্রকল্প। তবুও এর সামনে রয়েছে নানা জটিলতা ও চ্যালেঞ্জ, যা পায়রার ভবিষ্যতকে টেকসই ও লাভজনক করতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, বন্দরের আধুনিক জেটি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নদীর ওপর সেতুর নির্মাণকাজ ধাপে ধাপে এগোচ্ছে। বর্তমানেও পায়রা বন্দর সংলগ্ন এলাকায় নির্মাণকাজ ও পরিবহনব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে। কলাপাড়ার শূন্য চরাঞ্চল এখন শ্রমিকদের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তফা আশিক আলী জানান, ইতোমধ্যে প্রায় ৬৫০ মিটার দীর্ঘ জেটি নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। আন্ধারমানিক নদীর ওপর নির্মিত সেতু এবং সংযুক্ত মহাসড়কের কাজ শেষ হলেই ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে দ্রুত ও সহজ যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামী বছর জুলাই মাস থেকে বন্দরের সব কার্যক্রম নিয়মিত চালু হবে। বর্তমানে কয়লা ও পাথরের জাহাজ এখানে নিয়মিত ভিড়ছে এবং মালামাল হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বন্দরে প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এবং আয় হয়েছে মাত্র দুই হাজার কোটি টাকা। বন্দরের নৌচ্যানেলের গভীরতা বর্তমানে সাড়ে ছয় মিটার। তবে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে গভীরতা বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৫ মিটার করা গেলে এটি হবে দেশের গভীরতম নৌচ্যানেল। এর জন্য ইতোমধ্যে দুটি হপার ড্রেজার কেনার পরিকল্পনা চলছে।
ড্রেজিংয়ের খরচ কমানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতি কিউবিক মিটারের খরচ কমিয়ে ২ দশমিক ৮৮ ইউরো থেকে ১ দশমিক ৬ ইউরোতে আনা সম্ভব হয়েছে। যদিও পলিবহন সমস্যায় চ্যানেলে পলি জমে, যা নিয়মিত ড্রেজিং ছাড়া আটকানো সম্ভব নয়।
সরকার সম্প্রতি পায়রাবন্দরের উন্নয়নে তিনটি নতুন প্রকল্পের জন্য ৫ হাজার ৩১২ কোটি টাকার প্রস্তাব দিয়েছেঃ ে৩ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে রাবনাবাদ চ্যানেলে ড্রেজিং, ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় দুটি হপার ড্রেজার কেনা, ১৬১ কোটি টাকায় ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং ৪৯০ কোটি টাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন নির্মাণ।
অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম পায়রা বন্দরের ব্যাপারে বলেন, “পায়রা বন্দরের প্রকৃতি নদীবন্দর হিসেবে থাকা উচিত। গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে এটিকে বিকাশ করানো বাস্তবসম্মত নয়। বৃহৎ জাহাজ সরাসরি ভিড়তে পারবে না এবং এর ফলে এটি কখনই চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প হতে পারবে না। এজন্য সরকার অযৌক্তিক খরচের মধ্যে পড়েছে।”
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বর্ষায় বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাস ঘটলে রাবনাবাদ চ্যানেল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। চ্যানেলের কার্যকরী রাখার জন্য বছরে প্রায় ১০ কোটি কিউবিক মিটার পলি খনন প্রয়োজন, যার খরচ দাঁড়ায় ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, ডিআইএসএফ প্রকল্পের আওতায় প্রশাসনিক ভবন, সড়ক, পুনর্বাসন এলাকা ও জেটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। পিপিএফটি প্রকল্পে মালামাল হ্যান্ডলিং, টার্মিনাল ও বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপনের কাজ চলছে। এছাড়া কনটেইনার টার্মিনাল, এলএনজি টার্মিনাল, রেল সংযোগ, শিপ রিপেয়ার ফ্যাসিলিটি সহ বেশ কিছু অবকাঠামো অসম্পূর্ণ রয়েছে।
এছাড়া বন্দরে মোবাইল হারবার ক্রেন, ট্রেইলার, ট্রাক্টরসহ অনেক যন্ত্রপাতি এসেছে, যা কার্যক্রম চালু করতে সহায়ক হবে।
পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্বে পায়রাবন্দরে দুটি কনটেইনার টার্মিনাল, একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল এবং লিকুইড বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। এছাড়া ১,২০০ একর জমিতে ৪০০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য, ২০৪৩ সালের মধ্যে পায়রা বন্দরে পূর্ণ লাভজনকতা অর্জন করা এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় অর্থনীতির উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা রাখা।
এরই মধ্যে বসুন্ধরা, টিকে, প্রাণ-আরএফএল, মদিনা, এসিআইয়ের মতো বড় শিল্পগ্রুপ পায়রা বন্দরে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীন, জাপান, ডেনমার্ক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশও পায়রা বন্দরে বিনিয়োগে আগ্রহী।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. সুমিতা রহমান বলেন, “নদীপথ বন্দর হিসেবে পায়রা প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে উন্নয়ন করা দরকার। বড় ধরনের স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের আগে পরিবেশগত ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক প্রভাব বিশ্লেষণ অপরিহার্য।”
অর্থনীতিবিদ ড. রিয়াজ উদ্দিন মন্তব্য করেন, “পায়রা বন্দরের বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। ড্রেজিংয়ের ব্যয়ভার কমানোর জন্য সরকারি সহযোগিতা বৃদ্ধি ও আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ জরুরি। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে।”
পায়রা সমুদ্রবন্দর একদিকে দক্ষিণবাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সম্ভাবনা বহন করছে, অন্যদিকে প্রকৃতি ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে এর টেকসই উন্নয়ন বড় প্রশ্নের মুখে। প্রয়োজন সমন্বিত নীতি, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, যাতে দেশের অন্যতম এই সমুদ্রবন্দর দক্ষিণাঞ্চলের ভাগ্য বদলাতে পারে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ