
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের প্রবাসী নারী কর্মীদের বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে ভয়াবহ এক সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরেই রাজত্ব করছে, যা উচ্চ বেতনের স্বপ্ন দেখিয়ে হাজার হাজার নারীকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে তাদের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ, মানসিক ও যৌন নির্যাতন চালিয়ে আসছে। সরকারি নিয়মনীতি ও তদারকির প্রতি তোয়াক্কা না করে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এই অসাধু সিন্ডিকেট দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। শ্রমিকদের প্রতারিত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা, অন্যদিকে বিদেশে গিয়ে বিপদগ্রস্ত হচ্ছেন অসংখ্য নারী, যারা কখনো নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসছেন, কখনো হারাচ্ছেন জীবনের সম্মান, আবার কেউ পাচ্ছেন না ন্যায্য মজুরি বা মানবিক আচরণ।
বিদেশে কর্মী পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট এজেন্সির সবকাগজপত্র যাচাই-বাছাই করার দায়িত্বে থাকা বিএমইটির অন্তত কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের সহযোগিতায় অনিয়মপূর্ণ ফাইল অনুমোদন করা হয়, যেখানে অনেক ক্ষেত্রে জালিয়াতির মাধ্যমে পাসপোর্ট নম্বর, প্রশিক্ষণ ছাড়াই, কিংবা ন্যূনতম বয়স না পূরণ করেও নারীদের ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অন্তত ৫৩টি রিক্রুটিং এজেন্সি এই অনিয়ম ও জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত। তাদের মধ্যে মোসা. নূরজাহান আক্তারের নেতৃত্বে ‘টি-টোয়েন্টি ওভারসিজ লিমিটেড’ অন্যতম। তার এজেন্সির মাধ্যমে অনিয়মপূর্বক প্রশিক্ষণ ছাড়াই নারীদের বিদেশে পাঠানোর ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, মোসা নূরজাহানের এজেন্সি ছাড়াও ‘শিমুল এয়ার ওভারসিজ লিমিটেড’, ‘মাহী বিজনেস লিমিটেড’, ‘এমএস দ্য বাংলাদেশ ট্রেড করপোরেশন’, ‘এমএস জিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং’সহ শতাধিক এজেন্সির নাম পাওয়া গেছে যাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন পাসপোর্ট নম্বর ও ভিসা নম্বর জালিয়াতির মাধ্যমে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
বিএমইটির অনুমোদিত ১৬টি শর্ত লঙ্ঘন করে এজেন্সিগুলো কর্মীদের বিদেশ পাঠায়। ভাষা, সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই, কখনো বয়সসীমা পূরণ না করেই নারীদের বিদেশ পাঠানো হয়। এতে করে বিদেশে গিয়ে এসব নারী বিপদে পড়ে।
অনিয়মের এই চক্রে শুধু এজেন্সি নয়, বিএমইটির কর্মকর্তারাও জড়িত থাকায় তদারকি ও শাস্তির স্বচ্ছ ব্যবস্থা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রতিনিয়ত অসংখ্য নারীকে শোষণ করে নিজেদের পকেট ভারী করছেন।
নারী অভিবাসীদের সুরক্ষা ও অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, “এই বিষয়টিতে যেভাবে ‘যায়, নেয় ও পাঠায়’—তিন পক্ষেই অপরাধী রয়েছে। আর বিএমইটি হলো এই পুরো সিস্টেম মনিটরিং করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। যখনই কর্মকর্তারা এই দুষ্টচক্রের সঙ্গে জড়িত থাকবেন, তখন সুশাসন ফিরবে না। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।”
অন্যদিকে, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিএমইটির এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, “অনেক এজেন্সি ও আমাদের কর্মকর্তারাও প্রশিক্ষণ দিতে চান না। শুধু পাঠানোই হলো কাজ, এমন মানসিকতা সমস্যা তৈরি করছে। যাদের নিয়ে আমরা ভাবছি তারা আমাদের দেশেরই মা-বোন, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।”
সরকারি সংস্থাটি যদিও সুনির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য না করলেও অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আশরাফ হোসেন জানান, “আমরা চাই প্রত্যেক নারী কর্মী অন্তত সাত দিনের রিফ্রেশার ট্রেনিং পাবে, যেখানে তারা অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারবে এবং ভবিষ্যতে যেকোনো সমস্যার মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকবে।” তিনি আরও বলেন, “গত বছর রেমিট্যান্স ২৭ শতাংশ বেড়েছে, যদি সঠিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাহলে রেমিট্যান্স আরও ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো সম্ভব।”
তবে তিনি স্বীকার করেন যে, এখনো সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ ও তদারকি করা যাচ্ছে না।
অনিয়ম, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের কারণে বিদেশে গমনকারী নারী শ্রমিকদের জীবনমান ও নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে। ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, শোষণ, যৌন ও মানসিক নির্যাতন, আর পাচারের শিকার হওয়া ইত্যাদি অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের তৎপরতা ও কঠোর আইনি ব্যবস্থা ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ অসম্ভব। একই সঙ্গে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, তথ্য সরবরাহ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের প্রবাসী নারী শ্রমিকদের জীবন ও অধিকার রক্ষায় বিএমইটির দায়িত্ব অপরিহার্য। তবে বিএমইটির অভ্যন্তরে মিশে থাকা দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া এই সঙ্কটের অবসান সম্ভব হবে না।
৫৩টিরও বেশি রিক্রুটিং এজেন্সির নামে উঠে আসা অভিযোগের তদন্তে দ্রুতগতিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে নারী শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের অধিকার রক্ষা এবং দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি সম্ভব হবে।
সরকারি তৎপরতা, জবাবদিহিতা ও সমাজের সচেতনতা ছাড়া এই বেপরোয়া সিন্ডিকেটের জাল ছিন্ন করা অসম্ভব। তাই অবিলম্বে ব্যাপক অনুসন্ধান, জড়িতদের শাস্তি ও স্বচ্ছতার পদক্ষেপ নেওয়াই একমাত্র সমাধান।
বাংলাবার্তা/এমএইচ