
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বড় চালিকাশক্তি ও রপ্তানির প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প বর্তমানে একটি ভয়াবহ সংকটের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণার ফলে দেশের তৈরি পোশাক খাতে সংকট তীব্রতর হয়েছে। বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে তৈরি পোশাকের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপকে কেন্দ্র করে অবিশ্বাস ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, যা দেশের পোশাক রপ্তানির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণায় বাংলাদেশি তৈরি পোশাক পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা আগামী ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ওপর মোট শুল্কের হার দাঁড়াবে প্রায় ৫১ শতাংশের বেশি।
এই শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। বিশ্বখ্যাত ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টের কয়েকটি বড় অর্ডার স্থগিত বা বিলম্বিত হয়েছে বলে তিনজন বাংলাদেশি কারখানা মালিক ও ওয়ালমার্টের এক সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগাযোগে জানা গেছে। প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন জানিয়েছেন, ওয়ালমার্টের জন্য প্রায় ১০ লাখ পিস সাঁতারের প্যান্টের অর্ডার স্থগিত রয়েছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক বাড়ানো সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আমরা আশাবাদী, চলমান আলোচনা থেকে ইতিবাচক ফল আসবে। শুল্ক বহাল থাকলে, বিশেষ করে ৩৫ শতাংশের হার বজায় থাকলে, খাতের টিকে থাকা কঠিন হবে।”
বিজিএমইএ-এর সাবেক সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বর্তমানে এমন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির ফলে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের সামনে বড় ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতি সামাল না দিলে দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (ওটেক্সা) তথ্য অনুসারে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশি পোশাক আমদানি ছিল ৭.৩৪ বিলিয়ন ডলার। শুল্কের বর্তমান হার বিবেচনায় আমদানির মোট শুল্ক ছিল প্রায় ১.১৪ বিলিয়ন ডলার। নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্ক যুক্ত হলে শুল্কের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩.৭১ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২.৫৭ বিলিয়ন ডলার বেশি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অতিরিক্ত এই খরচ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্যের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় মারাত্মক ধাক্কা দেবে।
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিতীয় দফার বাণিজ্য আলোচনা কয়েক দফায় হয়েছে। যদিও অনেক বিষয়ে সম্মতি হয়েছে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। দুই পক্ষই আন্ত মন্ত্রণালয় পর্যায়ে আলোচনাকে অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে চীনের কাঁচামাল ব্যবহার কমানোর জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মার্কিন সরকার ‘রুলস অব অরিজিন’ নামে কঠোর নিয়ম প্রণয়ন করেছে, যা অনুযায়ী আমদানি পণ্যের অন্তত ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজন থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অনুসরণ করবে।
বাংলাদেশ এই শর্তগুলো মেনে নিতে নারাজ বলে জানানো হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের দাবি রয়েছে মেধাস্বত্ব সুরক্ষা, শ্রম অধিকার, শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রভৃতি ক্ষেত্রে আরও অগ্রগতি ঘটাতে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাজারের বড় ক্রেতারা বাড়তি শুল্কের কারণে নতুন অর্ডার স্থগিত রাখছে বা বিলম্ব করছে। প্রেরিত চালানের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ হলে খরচের একটি অংশ সরবরাহকারীদের ভাগ করতে হচ্ছে।
অনন্ত গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইনামুল হক খান বাবলু বলেন, “আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের বড় ক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তারা বলছে, পাইপলাইনে থাকা অর্ডারের কিছু অংশের বাড়তি শুল্ক বহন করতে হবে আমাদের।”
বিজিএমইএ এখনো প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের অপেক্ষায় আছে। তারা সরকারকে লবিস্ট নিয়োগের প্রস্তাব দিতে চায় যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আলোচনায় ইতিবাচক সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক বিষয়ক আলোচনায় ভিয়েতনাম ইতোমধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। তাদের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশকে দ্রুত অভ্যন্তরীণ খরচ নিয়ন্ত্রণ, কাঁচামাল সংগ্রহ বৈচিত্র্য এবং পণ্যের গুণগত মান উন্নত করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার পদক্ষেপ নিতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতির প্রাণ, যা কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের উৎস। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির মতো বৈশ্বিক পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন দ্রুত রণনীতি গ্রহণ ও বৈচিত্র্যময় বাজার খোঁজা।”
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ফারুক রহমান মন্তব্য করেন, “এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের বাণিজ্য নীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ এনেছে। শুল্ক কমানো না গেলে আমাদের বহুমুখী বাজারকরণ এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে।”
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বর্তমানে এক বিরাট সঙ্কটের সম্মুখীন। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির ফলে ক্রেতাদের অনিশ্চয়তা ও অর্ডার বিলম্ব অব্যাহত রয়েছে। তবে সরকারের উদ্যোগ ও শিল্প মালিকদের সচেষ্টতায় এই সংকট নিরসনে আলোচনা ও পদক্ষেপ চলছে।
তবে সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতার দক্ষতা বাড়ানো, উৎপাদন খরচ কমানো ও বৈশ্বিক বাজারের নতুন সুযোগের সন্ধান না নিলে পোশাক খাতের দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়ন ঝুঁকির মুখে পড়বে। দেশ-অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই খাত রক্ষায় দ্রুত ও কার্যকর সমাধানের প্রয়োজন অতীব জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ