
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়ে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, যাদের এতদিন অদৃশ্য বলে মনে করা হচ্ছিল, সেই শত্রুরাই এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। তাদের কর্মকাণ্ড এখন আর লুকানো নেই, বরং স্পষ্টভাবে জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তারা আর অদৃশ্য নেই।
শনিবার (১৩ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে ‘জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ছাত্রদল নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যদের’ নিয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, “আমি ৮-৯ মাস আগেই বলেছিলাম—এই দেশে অদৃশ্য শত্রু আছে, যারা গণতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। আজ সেই শত্রুরা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। তারা কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে, নানা ছদ্মবেশে জনগণের অধিকার খর্ব করার চেষ্টায় লিপ্ত। তারা গণতন্ত্রের শত্রু, তারা মানুষের কণ্ঠরোধ করে রাখতে চায়।”
সভায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিহত ছাত্রদল নেতাকর্মীদের স্বজনরা অংশ নেন। তারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাদের পরিবারের সদস্যদের শহীদ হওয়ার বর্ণনা দেন। এ সময় আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়, কান্নায় ভেঙে পড়েন উপস্থিত অনেকে, এমনকি তারেক রহমান এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও চোখ মুছতে দেখা যায়। কেউ খালি হাতে, কেউবা শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছছিলেন।
তারেক রহমান বলেন, “আমরা স্বৈরাচারকে পরাজিত করেছি, গণআন্দোলনের মাধ্যমে অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। আমরা যাদের বিপক্ষে লড়েছি, তারাই আবার নানা ছদ্মবেশে ফিরে আসছে—মোব ভায়োলেন্স, রাজনৈতিক হত্যা এবং রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের মাধ্যমে। যারা শহীদ হয়েছেন, তারা শুধু বিএনপির নয়—তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সৈনিক।”
তিনি অভিযোগ করেন, সরকারের মদদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গণহত্যা ও সহিংসতা সংগঠিত হচ্ছে, অথচ বিচার হচ্ছে না। “মিটফোর্ডের ঘটনা আমরা দেখেছি। স্ক্রিনে হত্যাকারীর মুখ দেখেও তাকে গ্রেপ্তার করছে না সরকার। বরং সে এসেছে বাইরের এলাকা থেকে, তাকে ‘প্রটেকশন’ দেওয়া হচ্ছে। নিহত ছেলেটি হয়তো যুবদলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল, কিন্তু তার হত্যার দায় সরকারের। একজন মানুষ হত্যা করলে তাকে আইনের আওতায় আনতেই হবে, সে যেই হোক।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা বারবার বলেছি—বিএনপি কখনো অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় দেয় না। সে বিএনপির হোক, ছাত্রদলের হোক বা অন্য যেকোনো দলের হোক—অপরাধ করলে বিচার হতেই হবে। কিন্তু আজ প্রশাসন, পুলিশ, আদালত—সব যেন দলীয় নির্দেশনায় চলছে। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে দেশ টিকবে না।”
“বিগত ১৫-১৬ বছরে শুধু বিএনপি-ই নয়, যুবদল, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন সংগঠনের শত শত নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন সাধারণ মানুষ, যারা শুধু ভোটাধিকার চাইতে গিয়েছিলেন। আজও তাদের বিচার হয়নি। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি—ভবিষ্যতে বিএনপি সরকার গঠন করতে পারলে আমরা প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার করব। শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না।”
তারেক রহমান বলেন, “স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে হয়তো, কিন্তু তার ভূত এখনও প্রশাসনে বাস করছে। আজও দেখা যাচ্ছে—সরকারি কর্মকর্তারা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব করছেন, নিরীহ মানুষকে হামলা-মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। নতুন করে এই ভূত জন্ম নিচ্ছে। আমরা এই প্রবণতা বন্ধ করতে চাই। প্রশাসনকে জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।”
তিনি একাধিকবার সতর্ক করেন যে, “ষড়যন্ত্র আবার জোরেশোরে শুরু হয়েছে। যারা অতীতে ৭১, ৯০ এবং ২৪-এ সাহস দেখিয়েছিল, তাদের মতো করে আমাদেরও প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের দেশটা কারো একার নয়, এটা ২০ কোটি মানুষের। তাই দেশ রক্ষার দায়িত্বও সবার।”
বিএনপির আলোচিত ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে তারেক রহমান বলেন, “তিন মাস আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে লিখিতভাবে জানিয়েছি—আমরা গণতান্ত্রিক বিচার ও পুনর্গঠনের পথ খুঁজছি। কিন্তু সরকার সেটা স্বীকার করছে না। বরং কিছু কিছু দল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিষয়টিকে ভিন্নভাবে তুলে ধরছে। জনগণ জানে সত্যটা কী।”
তিনি বলেন, “জুলাই সনদে আমাদের দাবি সুনির্দিষ্ট—গণহত্যার বিচার, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ, এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এটি কোনো দলের স্বার্থে নয়, পুরো জাতির ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি যখনই রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবে, এই সনদের সব শর্ত বাস্তবায়ন করবে। এটি আমাদের জাতীয় দায়বদ্ধতা।”
তারেক রহমান বলেন, “যারা এই রাষ্ট্রের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রাণ দিয়েছেন, তাদের পরিবারদের পাশে থাকাই আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা শুধু কথায় নয়, বাস্তব সহায়তা দিয়েও তাদের পাশে থাকব। প্রয়োজনে বিএনপি একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করবে শহীদ পরিবারদের সহায়তায়।”
সভায় আরও বক্তব্য দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যিনি সরকারকে আহ্বান জানান মব সহিংসতার প্রকৃত অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে। তিনি বলেন, “অন্যায়কারীদের বিচার করুন, না হলে জাতি আপনাদের ক্ষমা করবে না।”
সভায় উপস্থিত ছিলেন ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।
এছাড়া শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন: কক্সবাজারে শহীদ তানভীর সিদ্দিকীর বাবা বাদশা মিয়া, বরিশালে শহীদ তাহিদুল ইসলামের বোন ইশরাত জাহান, ঢাকা কাফরুলে শহীদ আকরাম খান রাব্বীর বাবা মো. ফারুক খান, ভোলায় শহীদ মহির হোসেনের ভাই হাসনাইন, টাঙ্গাইলে শহীদ ইমন মিয়ার ভাই মো. সুজন, মাগুরায় শহীদ মেহেদী হাসান রাব্বীর স্ত্রী রুমি খাতুন, নোয়াখালীতে শহীদ শাহাদাত হোসেন শাওনের ভাই মো. হানিফ, নরসিংদীতে শহীদ তাহমিদ ভূঁইয়ার মামা জোবায়ের মান্নান, দিনাজপুরে শহীদ সুমন পাটোয়ারীর বাবা ওমর ফারুক, কক্সবাজারে শহীদ ওয়াসিম আকরামের বাবা মো. শফি আলম এবং নোয়াখালীতে শহীদ ইমতিয়াজ হোসেন রিয়াজের বাবা মো. হাবিবুর রহমান প্রমুখ।
এই দীর্ঘ ও আবেগঘন মতবিনিময় সভায় তারেক রহমান শহীদ পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে পাশে থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “সত্যের পথ কখনো সহজ নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় হবেই।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ