
ছবি: সংগৃহীত
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিনের বিতর্ক অবসানে এক ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছেছে তারা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে আয়োজিত সংলাপের দ্বিতীয় পর্বের দ্বাদশ দিনের বৈঠকে এই ঐকমত্য গঠিত হয় বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহ-সভাপতি ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ।
রোববার (১৩ জুলাই) ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এ সংলাপে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ড. রীয়াজ জানান, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে আপাতত ‘জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে’ নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে।
তবে এটিকে স্থায়ী সমাধান না বলেই ‘বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে একটি কার্যকর সমঝোতা’ হিসেবে দেখছে কমিশন। ড. রীয়াজ বলেন, “প্রধান বিচারপতি কে হবেন, তা নিয়ে অতীতে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। জ্যেষ্ঠতা বা মেধার প্রশ্নে বিভাজন তৈরি হয়েছে। এবার দলগুলো বলেছে—বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামো মেনে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া উচিত।”
তবে এখানে একটি বিকল্প মতামতও সংযোজনের সুযোগ রাখা হয়েছে। ড. রীয়াজ বলেন, “জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের মধ্য থেকে (প্রথম দুইজনের মধ্যে) একজনকে নিয়োগ দেওয়ার বিধান সংবিধানে যুক্ত করা যায় কিনা—তা জনগণের রায় অনুসারে বিবেচনা করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি যুক্ত করতে পারবে।”
অর্থাৎ, জনগণ যদি নির্বাচনে ভোট দিয়ে এই প্রস্তাবের পক্ষে মত দেয়, তবে ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘নির্বাচনযোগ্য জ্যেষ্ঠতা’র বিধান চালু করা হতে পারে। এটি হলে জ্যেষ্ঠ দুই বিচারপতির মধ্যে রাষ্ট্রপতি কাউকে নিয়োগ দিতে পারবেন।
কমিশনের সহ-সভাপতি আরও বলেন, “আমরা চেষ্টা করেছি একটি বাস্তবধর্মী ও গ্রহণযোগ্য সমাধানের দিক নির্দেশনা দিতে। রাজনৈতিক দলগুলোও এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনা করেছে। মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে একটি সম্মত পদ্ধতির দিকে এগোনো আমাদের বড় অর্জন।”
এ সময় ড. রীয়াজ জানান, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে এই ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশপত্রে স্থান পাবে এবং তা দেশের আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামোর একটি উন্নত সংস্করণের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে।
এদিকে কমিশনের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, ক্ষমতাসীন দলের পাশাপাশি বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও অন্যান্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন এবং অধিকাংশই এই সমঝোতায় স্বাক্ষর করেছেন। তবে একটি ছোট দলের পক্ষ থেকে কিছু শর্ত যুক্ত করার প্রস্তাব থাকলেও তা মূল কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
এছাড়াও আলোচনায় আরও কিছু বিষয়ে মতবিনিময় হয়, যার মধ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিচারক নিয়োগে বিধিনিষেধ, এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক সংস্কার প্রস্তাবও ছিল।
প্রসঙ্গত, দেশের ইতিহাসে কয়েকবার এমন হয়েছে, যখন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে উপেক্ষা করে comparatively junior কাউকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়—যা নিয়ে আদালতের ভেতরে-বাইরে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব ও পছন্দ-অপছন্দের অভিযোগও উঠেছে সময় ও পরিস্থিতি ভেদে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই উদ্যোগকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলে মনে করছেন। তাদের মতে, এই ধরনের সংলাপ ও সম্মত প্রক্রিয়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে, যা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ