
ছবি: সংগৃহীত
আপনি হয়তো কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন—কাউকে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন, কয়েক ঘণ্টা পার হলেও কোনো উত্তর আসেনি। বেশিরভাগ মানুষ হয়তো ভাববেন, ‘সে ব্যস্ত আছে’। কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন, ‘সে নিশ্চয়ই আমাকে আর পছন্দ করে না’ বা ‘আমি হয়তো বন্ধুটিকে কষ্ট দিয়েছি!’ এই অতিরঞ্জিত ও আবেগপ্রবণ চিন্তা-প্রক্রিয়ার পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে রিজেকশন সেনসিটিভিটি ডিসফোরিয়া (RSD) নামের একটি অদেখা সমস্যা, যা বিশেষত ADHD (Attention Deficit Hyperactivity Disorder) আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে দেখা যায়।
এই সমস্যাটি এখনও কোনো আলাদা রোগ হিসেবে ক্লিনিক্যালভাবে স্বীকৃত না হলেও সাম্প্রতিক গবেষণা ও থেরাপিতে এটি বিশেষ মনোযোগ পাচ্ছে। চিকিৎসক ও মনোবিশেষজ্ঞরা এখন বিষয়টিকে ADHD-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
রিজেকশন সেনসিটিভিটি ডিসফোরিয়া (RSD) হলো এমন এক মানসিক অবস্থা যেখানে ব্যক্তি সামান্য সমালোচনা, উপেক্ষা কিংবা মতবিরোধেও চরমভাবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
একটি নিরীহ বাক্য—যেমন “তুমি তো এমনটা বলবে না ভেবেছিলাম”—এই বক্তব্যই তাদের কাছে হয়ে ওঠে চরম অপমান বা প্রত্যাখ্যান। এর ফলে তারা তীব্র আত্মসন্দেহে আক্রান্ত হন, নিজেকে গুটিয়ে নেন, ভেঙে পড়েন অথবা আত্মরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়ায় রেগে যান।
আরএসডি-তে আক্রান্ত কেউ হয়তো ভাবেন, “সে আমাকে আর সম্মান করে না”, “আমি কখনোই ভালো কিছু করতে পারি না”, বা “সবাই আমার পেছনে পড়ে আছে”—এসব চিন্তা তাদের আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়।
ADHD বলতে সাধারণভাবে আমরা মনোসংযোগের ঘাটতি বা অতিরিক্ত চঞ্চলতাকে বুঝি। তবে ADHD-তে আবেগ নিয়ন্ত্রণ একটি গভীর সমস্যা। গবেষণায় দেখা গেছে, ADHD রোগীদের মস্তিষ্কে অ্যামিগডালা (আবেগ শনাক্তকারী) ও প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (আবেগ নিয়ন্ত্রক) এর মধ্যে সঠিক সমন্বয় থাকে না।
এই অমিলের কারণে তারা আবেগকে অত্যন্ত তীব্রভাবে অনুভব করেন এবং তা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতেও সময় লাগে অনেক বেশি।
২০১৮ সালের একটি গবেষণায় প্রথমবার আরএসডির মতো আবেগজনিত সমস্যার প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়। দেখা যায়, এডিএইচডি আক্রান্ত কিশোরেরা তাদের সহপাঠীদের ছোট সমালোচনা বা মতবিরোধেও প্রবলভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন।
২০২৪ সালের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ADHD-র উপসর্গযুক্ত শিক্ষার্থীরা নেতিবাচক মূল্যায়নের ভয় বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আতঙ্কে ভোগে। এ কারণে তারা নিজেদের মতামত প্রকাশে দ্বিধাগ্রস্ত হন, অনেক সময় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও অন্যের সিদ্ধান্ত মেনে নেন।
২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক ADHD রোগীরাও অফিস বা পারিবারিক পরিবেশে হালকা সমালোচনাকেও ‘ব্যর্থতা’ বা ‘অযোগ্যতা’র প্রতীক হিসেবে দেখেন।
একজন উচ্চশিক্ষিত, পঞ্চাশোর্ধ নারী জানান—“ADHD ধরা পড়ার পর যখন আরএসডি সম্পর্কে পড়লাম, মনে হলো—আমার জীবনের এতদিনের অজানা সমস্যার ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছি।”
তিনি বলেন, “একটি সাধারণ অভিযোগ, ‘আপনি হয়তো এটি বেশি সিরিয়াসলি নিয়েছেন’—এমন কথা শুনেই নিজেকে অপমানিত মনে করতাম। তখন একা হয়ে যেতাম, এবং ভাবতাম, আমি কিছুতেই যথেষ্ট নই।”
ভিক্টোরিয়া বার্কলে-টিমিস, অস্ট্রেলিয়ার সাউদার্ন কুইনসল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের বিশেষজ্ঞ, RSD মোকাবিলায় কিছু কার্যকর কৌশলের পরামর্শ দিয়েছেন:
অনুভূতিকে নাম দিন: ‘এটা রিজেকশন ডিসফোরিয়া মনে হচ্ছে’—এইভাবে বললে আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
প্রতিক্রিয়ার আগে থামুন: ১০ থেকে ১ পর্যন্ত উল্টো গুনুন, গভীরভাবে শ্বাস নিন বা সামান্য হাঁটাহাঁটি করুন। এতে স্নায়ুতন্ত্র শান্ত হয়, আবেগ প্রশমিত হয়।
মনের গল্পকে চ্যালেঞ্জ করুন: ‘সে রিপ্লাই দেয়নি, কারণ সে ব্যস্ত’—এই সম্ভাবনাও তো সত্য হতে পারে। কল্পনার বদলে যুক্তিকে অগ্রাধিকার দিন।
থেরাপি নিন: দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হলে, বিশেষজ্ঞ কাউন্সেলর বা ADHD বিষয়ে অভিজ্ঞ থেরাপিস্টের সহায়তা নিন।
শিশুদের শিখান: ADHD আক্রান্ত শিশুদের আবেগ বুঝতে শেখান, এবং তাদের সীমাবদ্ধতা মেনে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলুন। ‘দ্য হোল-ব্রেন চাইল্ড’ বা সহায়ক বই পড়া উপকারী হতে পারে।
যদি আপনার পরিবারের কেউ বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু এই সমস্যায় ভোগেন, তাহলে তাদের প্রতি সদয় ও সরল ভাষায় কথা বলুন। মজা করে করা টিপ্পনী, কটাক্ষ বা অস্পষ্ট বার্তা এড়িয়ে চলুন। আপনার বাড়তি সচেতনতা ও সহানুভূতিই তাদের জীবনে নিরাপত্তা ও মানসিক স্থিতি এনে দিতে পারে।
রিজেকশন সেনসিটিভিটি ডিসফোরিয়া কোনো বিলাসিতা বা অলস আবেগ নয়, বরং এটি মস্তিষ্কের আবেগ-প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থার ভিন্নতা।
এটি দুর্বলতা নয়—একটি বাস্তব অনুভবযোগ্য চ্যালেঞ্জ। বোঝাপড়া, সহানুভূতি, উপযুক্ত থেরাপি ও আত্মসচেতনতার মাধ্যমে এ সমস্যাকে সামাল দেওয়া সম্ভব। এবং এর মধ্য দিয়েই ADHD আক্রান্ত একজন মানুষও স্বাভাবিক, আনন্দময় ও আত্মবিশ্বাসপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারেন।
নিজেকে বুঝুন, অন্যদের বুঝতে শিখুন—তবেই সম্পর্ক ও মানসিক স্বাস্থ্য দুই-ই সুন্দর থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ