
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে চলতি বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ছে আবারও। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, বাড়ছে প্রাণহানিও। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন আরও ৪২৫ জন, আর প্রাণ হারিয়েছেন ৩ জন রোগী।
এই তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। মঙ্গলবার (৮ জুলাই) দুপুরে প্রকাশিত এক নিয়মিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদিনে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন বরিশালে। সেখানে নতুন করে ১২০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যা দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জলাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত মশকনিধন কার্যক্রম এবং জনসচেতনতার অভাব বরিশালে ডেঙ্গু বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখছে।
এছাড়া ঢাকা মহানগরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন আরও ৮৮ জন রোগী। রাজধানীর বাইরের ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশন বাদে) নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬ জন। চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৮ জন, রাজশাহী বিভাগে ৪৮ জন, খুলনা বিভাগে ১৮ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১১ জন এবং সিলেট বিভাগে ১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডেঙ্গুর বিস্তার এখন আর শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক নয়—বরং এটি ক্রমেই বিভাগীয় শহর ও আশপাশের জেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ছে, যা সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে দেশে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ১৩ হাজার ১৮৮ জন।
স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার, ২০২৪ সালে সারা বছরজুড়ে (১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন। আর মৃত্যু হয়েছিল ৫৭৫ জনের।
এরও আগের বছর, ২০২৩ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ। সে বছর আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯-এ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭০৫—যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
বিশ্লেষকদের মতে, চলতি বছর পরিস্থিতি আগের বছরের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো থাকলেও বর্ষার প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, যা নিয়ন্ত্রণে না আনলে আগামী সপ্তাহগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের মশকনিধন কর্মসূচি পরিচালনার সমন্বিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বর্তমানে বিভিন্ন জেলা ও মহানগর এলাকায় ‘ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল’ হিসেবে কিছু এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিশেষ করে ঢাকার কিছু ওয়ার্ড, চট্টগ্রামের হালিশহর ও খুলশি, বরিশাল নগরের নলছিটি, রাজশাহী নগরের কাদিরগঞ্জ ও সাহেববাজার এলাকা, খুলনার রূপসা এবং ময়মনসিংহ শহরের কিছু অংশে এডিস মশার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। এসব এলাকায় ডোর টু ডোর সচেতনতামূলক কার্যক্রম, ফগিং, এবং লার্ভা ধ্বংসের কাজ চলমান রয়েছে।
তবে সেসব উদ্যোগ কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। নগরবাসীর অভিযোগ, অনেক এলাকায় নিয়মিত ফগিং বা ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না, আর ড্রেন বা নালা-নর্দমার সাফাই কার্যক্রমও খুবই সীমিত।
স্বাস্থ্য অধিদফতর পুনরায় জনসাধারণকে ডেঙ্গু নিয়ে সতর্ক থাকতে বলেছে। পাশাপাশি কী করবেন আর কী করবেন না—সে বিষয়ে জনসচেতনতামূলক বার্তাও দেওয়া হচ্ছে।
যা করবেন: ঘর ও আশপাশ পরিষ্কার রাখুন, জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলুন, ফুলের টব, ফ্রিজের পিছনে থাকা ট্রে, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি নিয়মিত পরিষ্কার করুন, দিনের বেলায়ও মশারি ব্যবহার করুন, কোনো উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
যা করবেন না: ডেঙ্গু হলে নিজে নিজে ওষুধ সেবন করবেন না, রক্তপাত শুরু হলে অবহেলা করবেন না এবং অসুস্থ অবস্থায় বাইরে ঘোরাঘুরি করবেন না।
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো ইতিমধ্যে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড চালু করেছে। তবে যেহেতু বর্ষা মৌসুম মাত্র শুরু, তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামী সপ্তাহগুলোতে রোগীর চাপ আরও বাড়বে। বিশেষ করে বিভাগীয় শহরগুলোর সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বেড, ওষুধ ও প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, এখনই যদি নাগরিক পর্যায়ে সচেতনতা ও স্থানীয় সরকারের সক্রিয়তা না বাড়ানো হয়, তাহলে পরিস্থিতি আবারও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
বর্ষা এলেই বাংলাদেশে ডেঙ্গু আতঙ্ক ফিরে আসে। যদিও গত বছর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, তবু বাস্তবতা বলছে—প্রস্তুতির ঘাটতি এখনও স্পষ্ট। চলতি বছর প্রথমার্ধে ডেঙ্গু পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকলেও এখন থেকেই নতুন করে ঝুঁকি বাড়ছে। তাই জনসচেতনতা, সময়মতো চিকিৎসা এবং সরকারি উদ্যোগ—এই তিন স্তরে সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া এই বিপদ ঠেকানো সম্ভব নয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ