
ছবি: সংগৃহীত
সরকারি হাসপাতালে ওষুধ চুরি করে বাইরে বিক্রি নতুন কোনো ঘটনা নয়, তবে এবার চুরি-জালিয়াতির কৌশল আরও নিখুঁত, আরও সুপরিকল্পিত হয়ে উঠেছে। সরকারি ওষুধকে বাইরে বিক্রি করা যেন সহজ হয়ে যায়, সে উদ্দেশ্যে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব দ্য চেস্ট অ্যান্ড হসপিটাল) ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের অর্থে কেনা কোটি কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে সাধারণ বেসরকারি (কমার্শিয়াল) মোড়কে। ফলে বাইরে বাজারে বিক্রি হলেও চেনার কোনো উপায় নেই যে এটি সরকারি ওষুধ—ফলে এর অপব্যবহার ধরা প্রায় অসম্ভব।
চলমান অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পাঁচ কোটি টাকার বেশি মূল্যের ওষুধ সরবরাহ করেছে আলেয়া করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ক্রয় নির্দেশনায় স্পষ্ট করে বলা আছে, সরকারি ওষুধে অবশ্যই ‘লাল-সবুজ মোড়ক’ ও অমোচনীয় কালিতে ‘সরকারি সম্পত্তি, বিক্রয়ের জন্য নহে’ লিখা থাকবে। এমনকি ২০২২ সালে প্রণীত ‘ঔষধ ও কসমেটিকস আইন’-এও স্পষ্ট বলা আছে, সরকারি ওষুধ চুরি বা বাইরে বিক্রি করলে ১০ বছর কারাদণ্ড অথবা ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।
সরকারি কোম্পানি ইডিসিএলের (Essential Drugs Company Ltd) সরবরাহকৃত ওষুধে এসব নির্দেশনা ঠিকভাবে মেনে চলা হয়েছে। কিন্তু আলেয়া করপোরেশন থেকে নেওয়া ওষুধের মোড়কে এসব কিছুই ছিল না। এমনকি কিছু পণ্যে ‘বিক্রয়ের জন্য নহে’ লেখা থাকলেও সেটা ছিল সাধারণ স্টিকারে, যা সহজেই উঠিয়ে ফেলা যায়। স্টোর ঘুরে দেখা গেছে Budicort 0.5, Windel Pluse, Clindacin 600, Widebac 50, Synova Normal Saline, Flindof, Pulmosis 267, Hexisol Hand Rub, Protinex প্রভৃতি নামী ব্র্যান্ডের ওষুধ প্যাকেট ছিল একদম কমার্শিয়াল মোড়কে।
একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এসব ওষুধ রিসিভের বিনিময়ে একটি সিন্ডিকেট উৎকোচ গ্রহণ করেছে এবং পরবর্তীতে এই ওষুধ বাইরে বাজারে বিক্রি করার সময় কেউ যাতে চিহ্নিত করতে না পারে, সে জন্যই এই মোড়ক পাল্টে ফেলা হয়েছে।
আলেয়া করপোরেশনকে দেওয়া ওষুধ ক্রয়ের কার্যাদেশ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তারা মোট ৫৫টি আইটেম সরবরাহ করেছে, যার মূল্য প্রায় ৫ কোটি ১৬ হাজার ৯৩১ টাকা। এর মধ্যে Budicort 0.5 এর এক লাখ পিসের মূল্য ৩৯ লাখ টাকা, Windel Pluse ১ লাখ ৫০ হাজার পিস—২৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, Widebac ৫০ ৪ হাজার পিস—২৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা, Clindacin ৬০০ পাঁচ হাজার পিস—৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এই তালিকা প্রমাণ করে, বাইরে পাচারযোগ্য এবং প্রচলিত বাজারদরের ওষুধগুলোই ছিল প্রধান টার্গেট।
অনিয়ম প্রসঙ্গে হাসপাতালের স্টোর ইনচার্জ মেডিকেল অফিসার ডা. আ.ন.ম আশিকুর রহমান খান বলেন, “লাল-সবুজ তো বাধ্যতামূলক, তবে জরুরি প্রয়োজনে ভিন্ন প্যাক নেওয়া হয়। আবার বিদেশি ওষুধেও লাল-সবুজ লেখা থাকে না।”
কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে, যেসব ওষুধের কথা বলা হচ্ছে তার অধিকাংশই দেশি এবং নিয়মিতভাবে লাল-সবুজ মোড়কে বাজারজাত হয়।
হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. আবদুল্লাহ আল মেহেদী সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে বলেন, “সব ওষুধ না, কিছু আইটেম নেওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে এমন হয়ে যায়, হয়তো যারা ইনভেন্টরি করে তাদের চোখ এড়ায়। তবে হ্যাঁ, যাই হোক, নিয়ম না মানা ঠিক হয়নি, ভবিষ্যতে সচেতন থাকবো।”
প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিকরা—কীভাবে এত বড় অঙ্কের কেনাকাটায় নজরদারি শূন্য থাকল? তিনি জবাবে বলেন, “কোম্পানিগুলো অনেক সময় ছোট ছোট আইটেম হলেও চাহিদামতো প্যাক দিতে চায় না। তখন আমরা কনসিডার করি।”
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. দেলোয়ার হোসেন নিজেই বলেন, “যেগুলো আমদানি হয়, সেখানে লাল-সবুজ পাবো কোথায়?” অথচ অনুসন্ধানে দেখা গেছে—দেশি কোম্পানির অনেক ওষুধও স্টোরে বেসরকারি মোড়কে জমা আছে। এই কথা বললে তিনি পাল্টা জিজ্ঞেস করেন, “আপনাকে কে বললো?” সাংবাদিক নিজেই স্টোর ঘুরে দেখেছে বললে তিনি বলেন, “অফিস টাইমে আসেন, তখন দেখবো।”
চুক্তিপত্রে দেওয়া ঠিকানায় আলেয়া করপোরেশনের অফিস খুঁজতে গিয়ে সাংবাদিকরা গিয়ে পায় একটি আবাসিক ভবন। ১৮/৭-জে, কেএম দাস লেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঠিকানায় গিয়ে তারা জানতে পারেন—সেখানে কোনো অফিস নেই। ভবনের বাসিন্দারাও জানান, সেখানে কখনো এমন কোনো অফিস ছিল না।
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। স্বাস্থ্যখাতের ওষুধ চুরির ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এই প্রতিবেদন প্রমাণ করে যে, নতুন আইন করেও অপরাধ ঠেকানো যাচ্ছে না। বরং এখন অপরাধ আরও সূক্ষ্ম এবং সংগঠিত হয়ে উঠেছে।
সরকারি সম্পদ অপব্যবহার, নীতিমালার লঙ্ঘন, জনগণের করের অর্থের অপচয় এবং চোরাচালানের সহায়ক পরিস্থিতি—এই তিনটি বিপজ্জনক উপাদানই এই ঘটনায় মিলে গেছে। প্রশ্ন উঠছে—এই দায় কে নেবে? কেন কর্তৃপক্ষ নিজেরাই অবৈধ সিন্ডিকেটের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকছে? কেন হাসপাতাল থেকে নিয়ে দোকানে ওষুধ বিক্রি করার রাস্তা সহজ করে দেওয়া হচ্ছে?
এই ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ে তদন্ত হওয়া জরুরি। জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় না আনলে সরকারি ওষুধের বাণিজ্যিক পাচার আগামীতে আরও বিস্তৃত আকার ধারণ করবে, যা জনস্বাস্থ্য, নৈতিকতা এবং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা—তিনটি ক্ষেত্রেই মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ