
ছবি: সংগৃহীত
বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের সংবেদনশীল ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে নির্বাচন ব্যবস্থায় ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ (Proportional Representation–PR) পদ্ধতি চালুর যৌক্তিকতা নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের গভীরভাবে ভাবনার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
গতকাল ১ জুলাই, মঙ্গলবার বিএনপি আয়োজিত ‘গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও শহীদ পরিবারের সম্মানে বিশেষ অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন তিনি। এসময় তারেক রহমান বলেন, “বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থা (পিআর পদ্ধতি) আমাদের জন্য কতটা উপযোগী বা আদৌ উপযোগী কিনা, তা সব রাজনৈতিক নেতাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার অনুরোধ করছি।”
তারেক রহমান বক্তব্যে আরও বলেন, “পিআর পদ্ধতির আড়ালে দেশে যদি আবার বিভক্তিমূলক রাজনীতি বা অনির্বাচিত ফ্যাসিস্ট শক্তির পুনর্বাসনের সুযোগ তৈরি হয়, তবে সেটি জাতীয় ঐক্যকে বিপন্ন করতে পারে। আমরা যেন ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তির দিকে ধাবিত না হই। তাই পিআর পদ্ধতির গঠনগত কাঠামো, বাস্তব প্রভাব এবং আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিপক্বতা—সব কিছু মিলিয়ে এর উপযোগিতা নিয়ে ভেবে দেখা দরকার।”
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভিত্তিকে মজবুত করতে হলে জনগণের ঐক্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিএনপির এই শীর্ষ নেতা। তিনি বলেন, “নিত্য নতুন ইস্যু সামনে এনে যদি বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়, তবে ষড়যন্ত্রকারীরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। ঐক্যবদ্ধ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিভ্রান্তিমূলক প্রস্তাব বা অপ্রয়োজনীয় সংস্কার আমাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঠামো ও নির্বাচনি ব্যবস্থায় সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে, তারা প্রত্যেকেই নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তাভাবনা করে প্রস্তাব দিয়েছে—এটি আমরা স্বীকার করি। তবে সব প্রস্তাবই বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে খাপ খায় কি না, তা বিচার-বিশ্লেষণ করা সবার দায়িত্ব।”
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি (PR) এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা যেখানে জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন বণ্টন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দল জাতীয়ভাবে ১০ শতাংশ ভোট পায়, তবে তারা সংসদে ১০ শতাংশ আসন পাবে—বাংলাদেশের ৩০০ আসনের প্রেক্ষাপটে তা দাঁড়ায় ৩০টি আসন।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত রয়েছে ‘প্রথম অবস্থানে বিজয়ী–First Past the Post’ (FPTP) পদ্ধতি, যেখানে প্রতিটি নির্বাচনি এলাকার বিজয়ী প্রার্থীই সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেন, যত স্বল্প ব্যবধানেই জিতুক না কেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রে একটি দল জাতীয়ভাবে কম ভোট পেয়েও বেশি আসন পেতে পারে।
পিআর পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, কমিউনিস্ট পার্টি, নাগরিক ঐক্যসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দল। তাদের দাবি, পিআর পদ্ধতি দেশে স্বচ্ছতা ও ইনক্লুসিভ রাজনীতিকে উৎসাহিত করবে এবং ছোট দলগুলোর জন্য জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করবে।
অন্যদিকে, বিএনপি এখন পর্যন্ত এই পদ্ধতির বিরোধিতায় অবস্থান নিয়েছে। তারা মনে করে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে পিআর পদ্ধতি অবকাঠামোগত দুর্বলতা, সামাজিক বিভাজন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। বর্তমান বাস্তবতায় এই পদ্ধতি রাজনৈতিক চুক্তি বা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেই তাদের আশঙ্কা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পিআর পদ্ধতি চালু থাকলেও এর ফলাফল মিশ্র। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ইসরায়েল ও জার্মানির মতো দেশগুলোতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। তবে এসব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জনতার রাজনৈতিক পরিপক্বতা বাংলাদেশের চেয়ে ভিন্ন।
সমালোচকরা বলেন, পিআর পদ্ধতিতে ছোট ছোট দল সংসদে ঢুকে পড়ে কখনও কখনও স্থিতিশীল সরকার গঠনে সমস্যা তৈরি করতে পারে। বারবার জোট ভাঙা-গড়ার মধ্যে পড়ে সরকার অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। আবার অনেক সময় মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক বা উগ্রপন্থি দলগুলোও অল্প ভোটে সংসদে প্রবেশ করে জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে।
তারেক রহমান এ বিষয়টিকেই সামনে এনেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থার আড়ালে আবার দেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট শক্তির পুনর্বাসনের পথ কি সুগম করা হচ্ছে না?”
বাংলাদেশ বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে—এমনটাই বলছে বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনে করেন, এই সময় একমাত্র পথ হতে পারে জাতীয় ঐক্য, জনসম্পৃক্ততা এবং বাস্তবভিত্তিক সংস্কার উদ্যোগ।
তিনি বলেন, “আলোচনার জন্য নতুন প্রস্তাব আসতেই পারে, বিতর্ক হতেই পারে, কিন্তু তা হতে হবে বাস্তবতাসম্মত, গণতান্ত্রিক এবং জনগণের সর্বোচ্চ মঙ্গল বিবেচনায়। নির্বাচন ব্যবস্থায় কোনো প্রকার পরিবর্তনের আগে বাংলাদেশের ইতিহাস, বর্তমান বাস্তবতা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা—সবই বিবেচনায় নিতে হবে।”
তারেক রহমানের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, বিএনপি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি নিয়ে এখনই কোনো চূড়ান্ত অবস্থানে না গেলেও বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ঐক্য, স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ বিবেচনায় এই পদ্ধতির বাস্তব প্রয়োগ কতটা লাভজনক হবে, সেটাই এখন প্রশ্ন।
এদিকে দেশে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার আলোচনার মধ্যে পিআর পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠছে। সব দলের মধ্যে এই বিষয়ে একটি উন্মুক্ত বিতর্ক শুরু হওয়া এবং যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত নেওয়া—এটাই এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ