
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রপ্তানি খাত বর্তমানে এক নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। বহির্বিশ্বের নানা চাপে সংযুক্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, যা দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য এক ভয়ঙ্কর সংকট তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক উত্তেজনা, বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা, আর্থিক অনিশ্চয়তা ও অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক সমস্যার জটিলতার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত ব্যাপক চাপে পড়েছে। বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা সতর্ক করছেন, এই সংকট দ্রুত সমাধান না হলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে বাধ্য।
পাশাপাশি চলমান বিভিন্ন বৈশ্বিক অস্থিরতা বাংলাদেশের রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে ভারতের পক্ষ থেকে স্থলপথে রপ্তানি বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞার বাড়িয়ে দেওয়ায়। ভারত গত কয়েক মাসে একের পর এক পণ্য ও খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যার ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির প্রায় ৬৫ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে শুধু বড় শিল্প নয়, ছোট-মাঝারি রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোও বড় সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিকেএমইএর সাবেক নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম আহসান।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অপর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্ক। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত এখনও সমঝোতায় পৌঁছায়নি, যা রপ্তানি খাতে বড় ধরনের বাধা হিসেবে কাজ করছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ও এই শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং সরকারের পক্ষ থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে এখনও আশঙ্কা কাটেনি। এই পরিস্থিতি রপ্তানি আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে সরকারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি থাকলেও ইউক্রেন-রাশিয়ার চলমান সংঘাতের কারণে ইউরোপের বাজারে রপ্তানি নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপের ক্রেতারা বর্তমান বৈশ্বিক অস্থিরতায় নতুন অর্ডার নিতে দেরি করছেন, যা বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বহির্বিশ্বের এই চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি দেশে এনবিআর সংস্কার নিয়ে চলমান প্রশাসনিক সংকট, কর্মকর্তাদের আন্দোলন ও শাটডাউনের কারণে রপ্তানির পথে নানা বাধা সৃষ্টি হয়েছে। কাস্টমস ছাড়পত্র প্রক্রিয়ায় জটিলতা ও বিলম্বের কারণে ক্রেতাদের অর্ডারকৃত পণ্যসমূহ সময়মতো সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
এছাড়া, দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের ক্রমাগত সংকট, এলসি জটিলতা এবং ডলারের দাম বৃদ্ধির মতো পুরনো সমস্যাগুলোও রপ্তানি খাতের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। এসব অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য রপ্তানি আয়ের ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, যার অর্থ প্রায় ৪৮.৯৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা গত অর্থবছরের প্রাক্কলিত ৫৭.৫ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে অনেক কম, যা বর্তমান সংকটের প্রকৃত প্রতিফলন।
বিকেএমইর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেছেন, “বহির্বিশ্বের সংকট ও অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমন্বয়ে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য চতুর্মুখী সংকটে পড়েছে। নতুন অর্ডার পাওয়ার ক্ষেত্রে ক্রেতারা অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছেন, ফলে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ইউরোপের বাজারে বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলেও ভারতীয় নিষেধাজ্ঞা ও এনবিআর সংকটের মতো অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো দ্রুত সমাধানযোগ্য। রপ্তানি খাতকে সচল রাখতে সরকারের উচিত যথাসম্ভব দ্রুত নীতি বাস্তবায়ন, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ এবং ক্রেতাদের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলা।
সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে আধুনিক প্রযুক্তি ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাস্টমস পরিষেবা দ্রুততর ও স্বচ্ছ করার প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক। পাশাপাশি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট সমাধানে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।
চতুর্মুখী সংকটের সম্মুখীন বাংলাদেশের রপ্তানি খাত এই মুহূর্তে একটি সংকটময় সংকীর্ণ গণ্ডিতে দাঁড়িয়ে আছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় জটিলতা দূর করতে দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। রপ্তানি খাতের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে প্রয়োজন সচেতনতা, দৃঢ় নেতৃত্ব এবং কার্যকর নীতিনির্ধারণ।
বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী অর্থনীতি সচল রাখতে এখন সময় এগিয়ে এসে ঐক্যবদ্ধভাবে সমস্যার সমাধান করার, নয়তো সংকট গভীর হতে থাকবে এবং বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে—একটি আশঙ্কাজনক বাস্তবতা যা উপেক্ষা করা যাবেনা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ