
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে আলোড়ন তোলা সাইবার অপরাধ—বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলায় এখনও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ২০১৬ সালে সংঘটিত এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ৮৬ বার সময় নিয়েছে সিআইডি, যা মামলার অগ্রগতির ধীরগতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।
তবে এবার আদালত আর ধৈর্য ধরেনি। ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. জাকির হোসেন বুধবার (৩ জুলাই) শুনানির দিন সিআইডিকে আগামী ২৪ জুলাইয়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়েছেন। এই দিন নির্ধারণ করে আদালত বলেন, "এটাই শেষ সময়। এরপর আর সময় দেওয়া হবে না।"
এদিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান নির্ধারিত সময়সীমা থাকা সত্ত্বেও আদালতে কোনো প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হন। এর ফলে বিচারক নতুন সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলেন, দীর্ঘসূত্রতার অবসান ঘটাতে হবে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা অ্যাকাউন্ট থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়ে যায়। হ্যাকাররা সুকৌশলে সুইফট কোডের মাধ্যমে ফান্ড ট্রান্সফার করে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (RCBC)-এর মাধ্যমে ওই অর্থ ম্যানিলা ও ক্যাসিনো নেটওয়ার্কে সরিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ও বাজেটিং বিভাগের উপপরিচালক জোবায়ের বিন হুদা ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় এই ঘটনাটি নিয়ে একটি মামলা করেন, যা পরবর্তীতে সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ঘটনার পর বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যায়। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ফিলিপাইন থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলার এবং শ্রীলঙ্কার একটি ব্যাংকে পাঠানো ২০ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
অর্থাৎ, মোট ৩৫ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা গেলেও এখনো প্রায় ৬৬ মিলিয়ন ডলার অনুপস্থিত, যার কোনো সুস্পষ্ট সুরাহা হয়নি।
২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, এই অর্থ পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি দেওয়ানি মামলা করে। মামলায় আরসিবিসি ও এর কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়। এই মামলা বর্তমানে চলমান রয়েছে।
২০২৩ সালের ২ মার্চ, নিউইয়র্ক সুপ্রিম কোর্ট মামলাটি চলমান রাখার অনুমতি দিলেও আরসিবিসির বিরুদ্ধে আনা কিছু অভিযোগ খারিজ করে দেয়। এর ফলে, আইনি প্রক্রিয়া আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, তারা এই মামলা পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক আইনি পরামর্শকদের সঙ্গে কাজ করছে এবং যথাযথ তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে অর্থ উদ্ধার নিশ্চিত করতে চায়।
সিআইডির তদন্তে এত বিলম্ব নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞ ও ব্যাংকিং বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন। ৮৬ বার সময় নেওয়া মানে ৮৬টি শুনানি পেছানো—যা শুধু এই মামলার গুরুত্বকেই খাটো করে না, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও নেতিবাচক বার্তা দেয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা এবং স্বচ্ছতার অভাবের কারণে মূল অপরাধী এবং তাদের গোষ্ঠীগত নেটওয়ার্ক আজও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে, যারা বাংলাদেশের ভেতর থেকে এই অপরাধে সহায়তা করেছে বলে সন্দেহ করা হয়, তাদের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট অগ্রগতি নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি নিয়ে বরাবরই সচেতন রয়েছে বলে দাবি করলেও তদন্ত অগ্রগতি সম্পর্কে তাদের পক্ষ থেকেও প্রকাশ্যে অনেক তথ্য জানানো হয় না। সরকারও এ বিষয়ে মাঝেমধ্যে কঠোর বার্তা দিলেও বাস্তব অগ্রগতি প্রশ্নবিদ্ধ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের আন্তর্জাতিক আর্থিক অপরাধের ক্ষেত্রে দ্রুত তদন্ত এবং প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ জরুরি, তা না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় সাইবার হুমকি সামনে আসতে পারে।
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অন্যতম বড় লজ্জার অধ্যায় হয়ে থাকা রিজার্ভ চুরি মামলার তদন্ত এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এখন দেখার বিষয়—সিআইডি আগামী ২৪ জুলাইয়ের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারে কি না, নাকি ৮৭তম বার সময় চাওয়ার নতুন ইতিহাস তৈরি হয়।
বাংলাদেশের জনগণ, অর্থনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক অংশীদাররা সকলেই এখন চায়—এই তদন্তের একটি পূর্ণাঙ্গ, নিরপেক্ষ ও দ্রুত সমাপ্তি। কারণ, শুধু অর্থের ক্ষতি নয়, এই চুরির ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ