
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে সরকারি চাকরির সবচেয়ে সম্মানজনক ও প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ প্রক্রিয়া হিসেবে পরিচিত বিসিএস পরীক্ষাকে ঘিরে এবার উঠেছে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। জানা গেছে, ২৯তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েও অন্তত ২১ জন প্রার্থীকে ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং দুর্নীতির শামিল বলে মনে করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিষয়টি এখন তদন্তাধীন এবং ইতোমধ্যে দুদক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম ও পদের তালিকা সংগ্রহ করে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান শুরু করেছে।
২৯তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল ও গেজেট প্রকাশিত হয় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু এর ১৩ মাস পর, অর্থাৎ ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি গেজেট প্রকাশ করে ২১ জন নতুন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়, যারা আগের চূড়ান্ত তালিকায় ছিল না এবং বিসিএস ক্যাডার হিসেবে নির্বাচিতও হননি। ওই সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার। তার সময়েই এই গেজেট প্রকাশ হয়, যা এখন তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, এই ২১ জন মূলত নন-ক্যাডার হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাদের বিসিএসের চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করেও ‘বিশেষ সুবিধা’র মাধ্যমে তারা প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র, কর, শিক্ষা, আনসার, পরিবার পরিকল্পনা, শুল্ক ও আবগারি এবং ইকোনমিক ক্যাডারসহ মোট ৯টি ক্যাডারে নিয়োগ পান। বিষয়টি কেবল অস্বাভাবিকই নয়, বরং বিসিএস পরীক্ষার স্বচ্ছতা, নৈতিকতা এবং মেধাভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থার ওপর বড় ধরনের আঘাত বলেও মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক বিশ্লেষক।
দুদকের প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুসারে, প্রশাসন ক্যাডারে সহকারী কমিশনার পদে নিয়োগ পাওয়া পাঁচজনের মধ্যে আছেন সাজিয়া আফরীন (মেধাক্রম ১৯৪), আসমাউল হুসনা লিজা (১৯৫), মোছা. নাসরীন পারভীন (১৯৬), সুলতানা রাজিয়া (১৯৭) ও মমতাজ বেগম (১৯৮)। তাদের সবাই আগে বিসিএস নন-ক্যাডার তালিকায় ছিলেন বলে জানা গেছে।
শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন চারজন: অষ্পড়া বড়ুয়া (মেধাক্রম ৭০), ফরিদা ইয়াসমীন (৭১), ফাহমিদা মাহজাবিন (৭২) ও রোখসানা খাতুন (৭৩)। ইকোনমিক ক্যাডারে সহকারী প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মিফতা-উল-জান্নাহ (৪২) ও ফারহানা রহমান (৪৩)।
পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া দুজন হলেন জামাল আল নাসের (১১) ও মোহাম্মদ কায়সার খসরু (১৩)। পররাষ্ট্র ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন সুভানা ইকরাম চৌধুরী (১৬)। পুলিশ ক্যাডারে আছাদুজ্জামান (৩৭) ও মাহফুজা আক্তার শিমুল (৩৯) নামে দুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
কর ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম (২৯), কামরুন নাহার শম্পা (৩০) ও মোসাম্মদ মাকসুদা ইসলাম (৩২)। সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন এ টি এম কামরুজ্জামান (৬৮)। আর আনসার ক্যাডারে সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন শামীম আহমেদ (১৪)।
প্রশ্ন উঠেছে, বিসিএস পরীক্ষার গেজেট প্রকাশের ১৩ মাস পর এই নিয়োগ কীভাবে এবং কার নির্দেশে সম্ভব হলো? জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি উইংয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার স্বাক্ষরিত ওই গেজেটে কী ধরনের যুক্তি দেখানো হয়েছিল, তা এখনও পরিষ্কার নয়। ধারণা করা হচ্ছে, ভুয়া মেধাক্রম দেখিয়ে এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ওই প্রার্থীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বর্তমান এপিডি উইংয়ের উপসচিব মোহাম্মদ রফিকুল হক বলেন, “এ ধরনের ঘটনা প্রমাণিত হলে প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর দুদক মামলা করে এবং সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়।”
এই ঘটনা সামনে আসার পর বিসিএস পরীক্ষার স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিবছর লাখ লাখ তরুণ-তরুণী বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন, কঠোর প্রস্তুতি ও কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তারা স্বপ্ন দেখেন একজন ক্যাডার কর্মকর্তার জীবন। অথচ এমন অনিয়মের ঘটনায় পুরো ব্যবস্থার ওপরই আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যদি এই ২১ জন প্রকৃত মেধা তালিকায় না থেকেও ক্যাডার পদে নিয়োগ পেয়ে থাকেন, তাহলে তা কেবল অন্যায্য নয়, বরং প্রতারণামূলক কাজ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। এবং যারা এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
২৯তম বিসিএসে নন-ক্যাডার প্রার্থীদের ক্যাডার পদে নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত এখন পুরোপুরি সক্রিয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও দুর্নীতি, পক্ষপাত এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে, যদি তা নিয়ন্ত্রণ না করা হয়। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে, বিসিএস পরীক্ষার স্বচ্ছতা রক্ষা করতে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর আরও কঠোর নজরদারি এবং জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
বাংলাবার্তা/এসজে