
ছবি: সংগৃহীত
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে দেশের ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো এখন বৃহত্তর নির্বাচনী জোট গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই জোটের মাধ্যমে তারা একক প্রার্থী ঘোষণা করতে চায় যাতে ইসলামপন্থি ভোটের বিভাজন রোধ হয় এবং নির্বাচনে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তোলা সম্ভব হয়। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দল একসঙ্গে আসার জন্য কাজ করছে এবং তাদের মধ্যে সমঝোতার ধারা ত্বরান্বিত হচ্ছে।
বর্তমানে অন্তত আটটি ইসলামী দল নির্বাচনী সমঝোতা প্রক্রিয়ায় রয়েছে, যারা নিবন্ধিত ও ভোটব্যাংক সমৃদ্ধ। এতে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট এবং খেলাফত আন্দোলন। এছাড়া মধ্যপন্থি দল এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) এই জোটে যোগ দিতে পারে বলে আলোচনা চলছে। তবে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নির্বাচনী জোটের বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যদিও তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দল পৃথকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।
নির্বাচনী সমঝোতা নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দলগুলো পরস্পরের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা, বৈঠক ও যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা নিয়মিত বৈঠকে বসছেন এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুতে সমন্বয় করছেন। তাদের প্রত্যাশা, সমঝোতা চূড়ান্ত হলে একক প্রার্থী দেওয়ার মাধ্যমে শক্তিশালী জোট গঠন সম্ভব হবে যা ইসলামপন্থি ভোটকে ঐক্যবদ্ধ করবে এবং নির্বাচনে জয় লাভের সুযোগ বাড়াবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতারা জানাচ্ছেন, অতীতের সমালোচনা ও বিরোধের বিষয়গুলো এখন বড় স্বার্থের জন্য প্রাধান্য হারিয়েছে। জামায়াতে ইসলামির একসময়ের কঠোর সমালোচক ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শীর্ষ নেতারা বলছেন, “বড় স্বার্থে আমরা ঐক্যবদ্ধ হবো। নির্বাচন শুধু ভোটের জন্য, তাই কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।” জামায়াতে ইসলামির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম এ ব্যাপারে বলেন, “অতীতে কে কী বলেছে তা এখন গুরুত্বপূর্ণ নয়, দেশের এবং উম্মাহর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরি।”
সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ইসলামী নেতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক রাজনৈতিক দিক থেকে নতুন প্রবণতা সৃষ্টি করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি ও তার মিত্ররা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে এবং একই সঙ্গে ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার গতি ত্বরান্বিত হয়েছে।
ইসলামী দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড গত দেড় দশক ধরে বিভিন্ন ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর জামায়াতে ইসলামি নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করে। একপর্যায়ে তারা বিভিন্ন দল ও সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে বৃহত্তর সমঝোতা গঠনের পরিকল্পনা করেছে।
এর ফলে, জামায়াতে ইসলামি দীর্ঘদিনের বিরোধ ও বিতর্ক ভুলে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই প্রক্রিয়ায় আলেম-উলামাদের সঙ্গে সম্পর্ক মধুর হচ্ছে এবং নির্বাচন সামনে রেখে একটি কার্যকরী সমঝোতা গঠনের লক্ষ্যে নানা আলোচনা ও বৈঠক চলছে।
খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং নেজামে ইসলাম পার্টি এই পাঁচটি কওমি ঘরানার দল জোট গঠনে অগ্রগামী। এদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠলে অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা আরও সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে দলের নাম, ফরম্যাট ও আসন বন্টন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও নেয়া হয়নি।
অপরদিকে, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এখনো কোনো নির্বাচনী জোটে অংশ নেবে না বলে জানিয়েছে। হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেছেন, “হেফাজতে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ কিংবা জোটের ব্যাপারে তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই, তবে হেফাজতের সদস্য বিভিন্ন দল পৃথকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।”
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিসের মতো দলগুলো নির্বাচনী রূপরেখা নির্ধারণে বৈঠক করছে এবং নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর জোটের চূড়ান্ত রূপ ও প্রার্থী বন্টন নির্ধারিত হবে বলে জানানো হয়েছে। জামায়াতে ইসলামি’র অভিজ্ঞ নেতারা মনে করেন, জোটের মাধ্যমে ইসলামি দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে নির্বাচনে সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
পরবর্তী দিনে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে এবং জাতীয় রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা কতটা শক্তিশালী হবে তা নির্বাচনের পরই পরিষ্কার হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত তারা পর্দার আড়ালে চলছে আলোচনা ও কৌশল নির্ধারণের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে ব্যস্ত থাকবে।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো বৃহত্তর জোট গঠনের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি সংযোজিত করতে চাইছে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ