
ছবি: সংগৃহীত
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আলোচিত একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিকুনগুনিয়া। কয়েক বছর আগেও রোগটির নাম অনেকেই জানতেন না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই ভাইরাসজনিত রোগটি অনেক অঞ্চলে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। যদিও এটি ডেঙ্গুর মতো প্রাণঘাতী নয়, তবুও এর যন্ত্রণা এবং দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক দুর্বলতা অনেক রোগীকেই মানসিক ও দৈহিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহর বিশ্লেষণে উঠে এসেছে রোগটি নিয়ে গভীর উদ্বেগের বিষয়গুলো।
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত জ্বর, যা ডেঙ্গুর মতোই এডিস মশার (Aedes aegypti এবং Aedes albopictus) কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। মূলত সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড়ানো মশাই অন্য ব্যক্তির শরীরে এই ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়। শুধু মানুষ নয়, কিছু বন্যপ্রাণী যেমন বানর, পাখি, ইঁদুর ইত্যাদির মধ্যেও এই ভাইরাসের জীবনচক্র বজায় থাকে।
একবার মশার মাধ্যমে মানবদেহে ভাইরাস প্রবেশ করলে সাধারণত ৪ থেকে ৮ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির আশপাশে যদি এই মশা থেকে যায়, তাহলে নতুন করে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
চিকুনগুনিয়া প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৫২ সালে আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব তানজানিয়া ও উত্তর মোজাম্বিক সীমান্তবর্তী এলাকায় মাকন্ডি জাতির মধ্যে। ২০০৬ সালে এটি ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এবং কয়েক হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়। এরপর ২০০৭ সালে ইতালি, ফ্রান্স, ক্রোয়েশিয়া এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলে রোগটি ব্যাপক আকার ধারণ করে।
২০১৫ সালে আমেরিকাজুড়েও এর ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় ২০০৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। এরপর ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে কিছু লোক আক্রান্ত হয়। তবে ২০১৭ সালে ঢাকা শহরে ব্যাপক হারে চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ে—যা ছিল অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়া প্রাদুর্ভাব। বর্তমানে বিশ্বের অন্তত ৬০টিরও বেশি দেশে রোগটির উপস্থিতি রয়েছে। বিশেষ করে আফ্রিকা, এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশে এর প্রকোপ বেশি।
‘চিকুনগুনিয়া’ শব্দটি এসেছে আফ্রিকার কিমাকন্ডি ভাষা থেকে, যার অর্থ—“ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া”। এই নামের পেছনের কারণ হলো, রোগীদের তীব্র ব্যথায় শরীর বেঁকে যায় এবং হাঁটতে গেলে তারা যেন ল্যাংড়াতে বাধ্য হন। এজন্যই একে অনেক সময় ‘ল্যাংড়া জ্বর’ নামেও অভিহিত করা হয়।
চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস সাধারণত এক সপ্তাহ পর্যন্ত শরীরে থাকে। এ সময় আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় দিলে মশাটি সংক্রমিত হয়ে পড়ে এবং অন্যদের কামড়ালে রোগ ছড়াতে পারে। তবে ৫-৭ দিন পর শরীরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় এবং ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
রোগটি সাধারণত প্রচণ্ড জ্বর দিয়ে শুরু হয়। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে থাকে:
মাথাব্যথা
বমি বা বমিভাব
শরীর দুর্বল হয়ে পড়া
লালচে র্যাশ বা ফুসকুড়ি
মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা
চলাফেরা কঠিন হয়ে যাওয়া
হঠাৎ অচেতন হয়ে যাওয়া (কিছু ক্ষেত্রে)
অনেক সময় জ্বর কমে যাওয়ার পরও শরীরের দুর্বলতা, অরুচি, বিষণ্নতা ও তীব্র গিঁটের ব্যথা থেকে যায়—যা স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত করে।
রোগ শনাক্তের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো উপসর্গ দেখা। জ্বর শুরুর ৫-৭ দিন পর রক্তে ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যেটি সেরোলজি বা আর-টি-পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। তবে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল রোগীদের জন্য এসব পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক নয়, কারণ চিকুনগুনিয়া নির্ণয়ে এগুলোর প্রয়োজন পড়ে না সব ক্ষেত্রে। জ্বরের ৪-৫ দিন পর রক্তের সাধারণ পরীক্ষা (CBC) করাও উপকারী।
চিকুনগুনিয়া সরাসরি ছোঁয়াচে নয়। আক্রান্ত ব্যক্তি সঙ্গে ঘুমালেও বা একই বাসায় থেকেও অন্যদের হওয়ার আশঙ্কা থাকে না, যদি না তাকে কামড়ানো মশা অন্যকে কামড় দেয়। অর্থাৎ রোগটি ছড়ায় শুধুমাত্র মশার মাধ্যমে।
চিকিৎসা মূলত উপসর্গভিত্তিক। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামলই যথেষ্ট। কোনো অবস্থাতেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া আইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন বা ডাইক্লোফেনাক সেবন করা উচিত নয়।
রোগীর শরীর ঠান্ডা পানি দিয়ে স্পঞ্জ করা, বিশ্রামে রাখা, প্রচুর পানি, ডাব, শরবত, স্যুপ ও তরল খাবার খাওয়ানো দরকার। ফিজিওথেরাপি ও হালকা ব্যায়াম করলে গিঁটের ব্যথা সহজে সেরে ওঠে। তবে গরম সেঁক নয়, বরফ সেঁক কার্যকর।
বিশেষ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে স্টেরয়েড দেওয়া যেতে পারে, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে নয়। অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণত প্রয়োজন হয় না, তবে অন্য সংক্রমণ থাকলে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
চিকুনগুনিয়ায় ৮০-৯০ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে ১০ শতাংশের কম কিছু রোগীর শরীরে কয়েক সপ্তাহ বা মাসজুড়ে তীব্র গিঁটের ব্যথা থেকে যায়। এটি এত তীব্র হতে পারে যে, ভুক্তভোগীরা স্বাভাবিক জীবনযাপন হারিয়ে ফেলেন। অনেকেই বলেন, “হাতুড়ি দিয়ে শরীর পেটানো হয়েছে”—এমনটাই লাগে।
তবে মনে রাখতে হবে, চিকুনগুনিয়ায় সাধারণত মৃত্যু হয় না। তবে যাদের আগে থেকেই ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি, লিভার সমস্যা বা ক্যানসার রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এটি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
চিকুনগুনিয়ার কোনো প্রতিষেধক নেই। ভ্যাকসিন বা টিকা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তাই একমাত্র কার্যকর পদ্ধতি হলো মশা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যক্তিগত সতর্কতা।
এডিস মশার জন্মস্থল নষ্ট করা (যেমন ফুলের টব, পুরোনো টায়ার, ফ্রিজ ট্রে, জমে থাকা পানি)
মশারির ব্যবহার
শরীর ঢেকে রাখার মতো পোশাক পরা
মশা তাড়ানোর জন্য অ্যারোসল বা স্প্রে ব্যবহার করা
চিকুনগুনিয়া যদিও প্রাণঘাতী নয়, তবে এর তীব্রতা এবং দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণা রোগীদের ভীত ও বিপর্যস্ত করে তুলছে। এজন্য প্রয়োজন সময়মতো চিকিৎসা, সচেতনতা এবং সর্বোপরি মশাবাহিত রোগের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এখনই সময় সাবধান হওয়ার, কারণ একবার ছড়িয়ে পড়লে এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়ে।
সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ