
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর লাগাতার সামরিক অভিযানে একদিনেই প্রাণ হারিয়েছেন আরও অন্তত ৭২ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরও ১৭৪ জন। শুক্রবার (২৭ জুন) গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে এই তথ্য জানিয়েছে তুরস্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি। চলমান যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র আরও একবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই প্রাণহানির ঘটনায়।
শুক্রবার সারাদিন গাজার বিভিন্ন অংশে ইসরাইলি বিমান ও ড্রোন হামলার পাশাপাশি স্থল অভিযানও চালানো হয়। বেশ কয়েকটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় চালানো আঘাতে নারী ও শিশুরা নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। আল-মাঘাজি, খান ইউনুস এবং রাফাহ—এই তিন এলাকায় সবচেয়ে বেশি হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনও লাশ উদ্ধার কার্যক্রম চলমান থাকায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি অভিযানে এখন পর্যন্ত ৫৬,৩৩১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১,৩২,৬৩২ জন। এই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে এবং গাজার অবকাঠামো ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে।
আহতদের অনেকেই বেঁচে থাকলেও তাদের অনেকের অঙ্গহানি হয়েছে, অনেক শিশু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সংকট আরও গভীর হয়েছে ওষুধ, খাদ্য ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ভয়াবহ সংকটের কারণে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ইসরাইলের সীমান্ত অতিক্রম করে এক আকস্মিক ও সমন্বিত হামলা চালায়। ওই হামলায় ১,২০০ ইসরাইলি নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস যোদ্ধারা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ইসরাইল পুরোদমে গাজা আক্রমণ শুরু করে।
এরপর থেকে ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় দফায় দফায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF)। গত ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের চেষ্টায় একপ্রস্থ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও তা টেকেনি।
২০২৪ সালের ১৮ মার্চ থেকে ফের শুরু হয় ইসরাইলের দ্বিতীয় দফা সামরিক অভিযান। গত আড়াই মাসে এ অভিযানে নিহত হয়েছেন আরও ৬,০০৮ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন ২০,৫৯১ জন। শুধু মানুষই নয়, বিধ্বস্ত হয়েছে গাজার স্কুল, হাসপাতাল, শরণার্থী শিবির ও বিদ্যুৎ–পানি সরবরাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো।
২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হাতে যে ২৫১ জন ইসরাইলি জিম্মি হয়েছিল, তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ জনকে মুক্ত করা হয়েছে। তবে এখনো অন্তত ৩৫ জন জীবিত জিম্মির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী। তাদের উদ্ধারে সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে আইডিএফ।
এই উদ্ধারের অজুহাতেই ইসরাইলি বাহিনী যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করে ফের গাজায় প্রবল হামলা শুরু করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও ইসরাইল বলছে, এটি “আত্মরক্ষামূলক অভিযান”।
জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজায় চলমান সহিংসতা এবং ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মতে, গাজা এখন বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখোমুখি। শিশুদের অপুষ্টি, বিশুদ্ধ পানির সংকট, আশ্রয়হীনতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধ্বংস—সবকিছু মিলিয়ে এক 'মানবিক নরক' সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (WFP) এবং ইউনিসেফ।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) ইতোমধ্যে গাজার পরিস্থিতি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে এবং ইসরাইলি নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনার প্রক্রিয়াও চলছে। তবে ইসরাইল ও তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
গাজায় প্রতিদিনের হামলা যেন মৃত্যুকে নিয়ত করে তুলেছে ফিলিস্তিনিদের জীবনে। একদিনে ৭২ জনের প্রাণহানি শুধু পরিসংখ্যান নয়, এটি এক গভীর বেদনাবিধুর মানবিক সংকটের চিত্র। সংঘাত নিরসনে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা কার্যকর হচ্ছে না, বরং যুদ্ধ আরো দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি দ্রুত কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে সামনে আরও বড় মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে গাজা ও গোটা মধ্যপ্রাচ্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ