
ছবি: সংগৃহীত
প্রবাসে অবস্থানরত প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশির ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নতুন পদ্ধতির খসড়া নিয়ে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় ‘প্রক্সি ভোটিং’ পদ্ধতিকে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করলেও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল স্পষ্টভাবে এর বিরোধিতা করেছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ একাধিক দল মত দিয়েছে—প্রবাসীদের ভোটাধিকারে প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপদ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থা যেমন পোস্টাল ব্যালট বা অনলাইনভিত্তিক পদ্ধতি চালু করা হোক, কিন্তু ‘প্রক্সি’ পদ্ধতি যেন না হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত, নির্বাচন কমিশনের অবস্থান, আইনি বাধা ও বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে বর্তমানে চলেছে জোর আলোচনা।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার প্রয়োগের তিনটি বিকল্প পদ্ধতি—অনলাইন ভোটিং, পোস্টাল ব্যালট ও প্রক্সি ভোটিং—নিয়ে ২৪টি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে মতামত চাওয়া হয়। এর মধ্যে ২২টি দল লিখিত এবং ১টি দল মৌখিক মতামত প্রদান করে। অন্য একটি দল কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নেয়নি।
মতামতের হিসাব বলছে, ১৮টি দল অনলাইন পদ্ধতির, ১৫টি দল পোস্টাল ব্যালটের, আর মাত্র ৮টি দল প্রক্সি ভোটিংয়ের পক্ষে মত দিয়েছে। বিএনপি একমাত্র পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), খেলাফত মজলিসসহ কয়েকটি দল যৌথভাবে অনলাইন ও পোস্টাল পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে। এলডিপি সীমিত পরিসরে পোস্টাল ব্যালট চালুর পক্ষে মত দিলেও নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি এবং জেএসডি তিনটি পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনো মতামত দেয়নি। ইসি সূত্র মতে, এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ অনুপস্থিতি।
ইসির একাধিক সূত্র বলছে, শুরুতে ‘প্রক্সি ভোটিং’ পদ্ধতিকেই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত এবং কার্যকরী পদ্ধতি হিসেবে ভাবছিল নির্বাচন কমিশন। ১৭ মার্চ এক অনুষ্ঠানে কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেছিলেন—“বড় পরিসরে প্রবাসীদের ভোটাধিকার দিতে চাইলে প্রক্সি ভোটিং ছাড়া আর কোনো কার্যকর পদ্ধতি দেখি না।” পরবর্তীতে ২৭ এপ্রিল এক সেমিনারে রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে ইসি।
সেমিনারে রাজনৈতিক দলগুলো প্রক্সি ভোটিংয়ের স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও কারচুপির ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তারা বলে, প্রক্সি পদ্ধতি বাংলাদেশের মতো দেশে নির্বাচনী অনিয়মের নতুন পথ খুলে দিতে পারে।
এই মতামতের ভিত্তিতে ইসি বর্তমানে ‘আইটিভিত্তিক পোস্টাল ব্যালট’ পদ্ধতির দিকেই ঝুঁকছে বলে নিশ্চিত করেছে কমিশনের একাধিক সূত্র। এই পদ্ধতিতে প্রবাসীরা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে ডাকযোগে ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন।
কমিশন সূত্র জানায়, আসন্ন নির্বাচনে প্রবাসী ভোটারদের জন্য ভোটগ্রহণের আগেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনলাইন আবেদন করতে হবে। অনলাইন নিবন্ধনের মাধ্যমে তার নাম প্রবাসী ভোটার তালিকায় যুক্ত হবে এবং স্থানীয় কেন্দ্রীয় তালিকা থেকে বাদ পড়বে। পরে ওই ভোটার পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিয়ে নির্দিষ্ট ঠিকানায় ফেরত পাঠাবেন।
এই পদ্ধতিতে দ্বৈত ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। একজন প্রবাসী অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করলেও ভোটের সময় দেশে এসে কেন্দ্রেও ভোট দিতে পারবেন না।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান আইনে প্রবাসী, সরকারি কর্মচারী এবং হেফাজতে থাকা ব্যক্তি পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার অধিকার রাখেন। তবে এতদিন এই পদ্ধতির বাস্তব প্রয়োগ কার্যকর ছিল না।
পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি বাস্তবায়নে অন্যতম চ্যালেঞ্জ খরচ এবং সময়। ২৪ জুন নির্বাচন কমিশনের এক বৈঠকে এই ব্যয়-পর্যালোচনা নিয়ে আলোচনা হয়। এতে সরকারি ডাক বিভাগ এবং আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সংস্থা ফিডেক্স ও ডিএইচএল-এর প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
ডাক বিভাগের মহাপরিচালক জানান, পোস্টাল ব্যালট প্রেরণ ও ফেরত আনতে জনপ্রতি ৪০০-৫৫০ টাকা খরচ হবে, তবে এটি নির্ভর করবে দেশের অবস্থান ও বিমানের সময়সূচির ওপর। অন্যদিকে ফিডেক্স ও ডিএইচএল জানায়, তারা গোপনীয়তা নিশ্চিত করে ব্যালট ফেরত আনতে পারবে, তবে সময় লাগবে অন্তত ১০-১২ দিন এবং জনপ্রতি খরচ হতে পারে ৫ হাজার টাকার মতো।
সব দেশের ক্ষেত্রে পোস্টাল ব্যালট পাঠানো সম্ভব হবে না বলেও জানানো হয়।
এই পদ্ধতি কার্যকর করতে হলে নির্বাচন আচরণবিধি (RPO) এবং নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা সংশোধনের প্রয়োজন হবে। কমিশন ইতোমধ্যে সংশোধনী খসড়া প্রস্তুত করছে। নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী নেওয়াজ বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামত দিয়েছে, এখন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
নির্বাচনী বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রক্সি ভোটিংয়ের মতো অনির্ভরযোগ্য ব্যবস্থায় না গিয়ে, প্রযুক্তিনির্ভর এবং স্বচ্ছ পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া উচিত। তারা মনে করেন, পোস্টাল বা অনলাইন পদ্ধতি ব্যয়বহুল হলেও গ্রহণযোগ্যতা বেশি। বিশেষ করে ভোটার যাচাই ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে আইটি-ভিত্তিক প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য।
তবে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্বেগও বাড়ছে—সত্যিকার অর্থে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে, নাকি নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব শুধুই রাজনৈতিক চাপে সমন্বয়ের চেষ্টা?
প্রবাসী ভোটারদের অন্তর্ভুক্তি গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তবে তা যেন একটি অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্র না হয়ে ওঠে—এমন নিশ্চয়তা দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। প্রক্সি নয়, প্রযুক্তিনির্ভর ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাই প্রবাসীদের ভোট নিশ্চিত করতে পারে, বলছেন অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকরা। সময়ের দাবি হলো—দ্রুত, স্বচ্ছ, এবং নিরাপদভাবে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, যা বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আরও গ্রহণযোগ্য এবং আধুনিক করে তুলবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ