
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ক্রিকেটের নেতৃত্বে এক বছরের ব্যবধানে আবারও বড় পরিবর্তন। আর সে পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে নাজমুল হোসেন শান্ত। অনেকটা প্রত্যাশিতভাবেই তিনি টেস্ট অধিনায়কত্ব থেকেও সরে দাঁড়ালেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোতে শেষ হওয়া দ্বিতীয় টেস্টে হারের পর ম্যাচ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এসে নিজেই এ ঘোষণা দিয়েছেন বাঁহাতি এই ব্যাটার। এক পর্যায়ে যার কাঁধে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তিন ফরম্যাটের দায়িত্বই তুলে দিয়েছিল, আজ সেই শান্তই আর কোনো ফরম্যাটে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন না।
২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসানের অধিনায়কত্বের অধ্যায় শেষে তরুণ নেতৃত্বে রূপান্তর ঘটায় বিসিবি। তখন হুট করেই সব ফরম্যাটে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় নাজমুল হোসেন শান্তর কাঁধে। বিসিবির চোখে তিনি তখন ভবিষ্যতের নেতা, টেকসই এক ক্যাপ্টেন যিনি নতুন প্রজন্মকে নেতৃত্ব দেবেন।
নেতৃত্বের দায়িত্ব পেয়ে শান্তও প্রথমদিকে নিজেকে প্রস্তুত প্রমাণ করতে সচেষ্ট ছিলেন। মাঠে নেতার মতোই ভাব প্রকাশ, কঠিন সময়েও মাথা ঠান্ডা রাখা, সতীর্থদের উৎসাহ দেওয়া—সব মিলিয়ে শান্তর মধ্যে নেতৃত্বগুণের ইঙ্গিত দেখেছিল অনেকে। তবে মাঠের ফলাফল তা ঠিক তুলে ধরেনি।
শান্তর নেতৃত্বে দল যখন ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করতে পারছিল না, তখন থেকেই গুঞ্জন শুরু হয় তার নেতৃত্ব ভবিষ্যৎ নিয়ে। গত বছরই একবার নেতৃত্ব ছাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন শান্ত নিজেই। তবে তখন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন তাকে বোঝান, দায়িত্ব চালিয়ে যেতে। শান্ত তখন শুধু টি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব ছেড়ে দেন, বাকিটা বজায় রাখেন।
এবার অবশ্য বিসিবির পক্ষ থেকেই একটা স্পষ্ট বার্তা এসেছিল ওয়ানডে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে। চলতি শ্রীলঙ্কা সফরের আগে বোর্ড জানায়, শান্ত আর ওয়ানডে অধিনায়ক থাকছেন না, তার পরিবর্তে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজকে। তখন থেকেই অনুমান চলছিল, হয়তো টেস্টের নেতৃত্ব থেকেও সরে আসবেন শান্ত। শেষ পর্যন্ত সেটাই হলো বাস্তব।
নাজমুল হোসেন শান্ত টেস্টে অধিনায়ক হিসেবে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ১৪টি ম্যাচে। এর মধ্যে জয় এসেছে চারটি টেস্টে। জয়ের তালিকায় রয়েছে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুটি, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি এবং জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি ম্যাচ। যদিও প্রতিপক্ষ বিবেচনায় এসব জয়কে বড় করে দেখা যায় না, তবে বাংলাদেশ দলের অতীত সাফল্য বিবেচনায় তা একেবারে খাটো করে দেখাও সম্ভব নয়।
ওয়ানডে ফরম্যাটে শান্তর অধীনে বাংলাদেশ খেলেছে ১৩টি ম্যাচ, যার মধ্যে জয় এসেছে চারটিতে। নেতৃত্বের চাপের মধ্যেও শান্ত নিজের পারফরম্যান্সে উন্নতি আনতে পেরেছেন। যেখানে টেস্ট ক্যারিয়ারে তার ব্যাটিং গড় ৩২, সেখানে অধিনায়ক হিসেবে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬-এ। তার সাতটি টেস্ট সেঞ্চুরির মধ্যে তিনটি এসেছে অধিনায়ক থাকার সময়। এর সঙ্গে অধিনায়কত্বকালে দুটি অর্ধশতকও আছে।
ওয়ানডেতে তো আরও বিস্ময়কর পারফরম্যান্স করেছেন শান্ত। তার ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৩৪, অধিনায়ক হিসেবে সেটি লাফ দিয়ে পৌঁছে গেছে ৫১-এ। তার ওয়ানডে ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস—১২২ রান (অপরাজিত)—এসেছে নেতৃত্বকালেই। সেই ইনিংসে যেমন ছিল স্থিরতা, তেমনি ছিল আত্মবিশ্বাস আর পরিণত ব্যাটিং। শুধু গড় নয়, স্ট্রাইক রেটেও উন্নতি হয়েছে নেতৃত্ব নেওয়ার পর।
তবে টি-টোয়েন্টিতে ছবিটা ঠিক উল্টো। অধিনায়ক হওয়ার পর এ ফরম্যাটে শান্তর গড় ও স্ট্রাইক রেট দুটোই কমেছে। ব্যাট হাতে তিনি ছিলেন অস্পষ্ট, মাঠে সিদ্ধান্তেও অনিশ্চয়তা কাজ করেছে। এ কারণে টি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব প্রথমে ছেড়েছিলেন।
নেতৃত্ব ছাড়ার পেছনে শান্তর ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা যতই থাকুক না কেন, এই সিদ্ধান্তে মাঠের ফলাফল, বোর্ডের সিদ্ধান্ত এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। দীর্ঘদিন ধরে দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে বোর্ডের টানাপোড়েন, নতুনদের নিয়ে দল গঠনের পরীক্ষানিরীক্ষা—সব মিলিয়ে নেতৃত্ব পাওয়া যেমন চ্যালেঞ্জ ছিল, তেমনি সেটা ধরে রাখাও হয়ে উঠেছিল কষ্টকর।
এমনকি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সদ্যসমাপ্ত টেস্ট সিরিজেও বোর্ডের ভেতরে টানাপোড়েন স্পষ্ট হয়েছে। ম্যাচের মধ্যেই নতুন অধিনায়ক ঘোষণা নিয়ে গুঞ্জন ছড়িয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে মাঠে মনোযোগ ধরে রাখা, খেলোয়াড়দের একত্র করা—এই চাপ সম্ভবত শান্তর মতো তরুণ নেতার পক্ষে দীর্ঘদিন সামলানো সম্ভব হয়নি।
নেতৃত্ব ছাড়লেও শান্তর ক্রিকেট ক্যারিয়ার থেমে নেই। বরং নেতৃত্বের চাপ থেকে মুক্ত হয়ে হয়তো নিজের ব্যাটিংয়ে আরও মনোযোগ দিতে পারবেন তিনি। বিশেষ করে টেস্ট ও ওয়ানডেতে তার ব্যাটিং সামর্থ্য নিয়ে কারও সংশয় নেই। এখন তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—স্রেফ একজন ব্যাটার হিসেবে দলে নিজের জায়গা পোক্ত করা এবং নতুন অধিনায়কের অধীনে কার্যকর ভূমিকা পালন করা।
শান্তর নেতৃত্ব ছাড়ার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। তরুণ নেতৃত্বের পরীক্ষাটি সম্ভবত সফল হয়নি, কিংবা আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়—পর্যাপ্ত সমর্থন, সময় ও স্থির পরিকল্পনা না থাকায় এই অধ্যায়টি অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। তবে নেতৃত্বের বাইরে থাকলেও শান্ত যদি তার ব্যাটে ধার ফিরিয়ে আনতে পারেন, তবেই হয়তো সত্যিকারভাবে প্রমাণ করতে পারবেন যে, তিনি শুধু নেতা হিসেবে নয়, বরং ক্রিকেটার হিসেবেও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ