
ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগ সরকারের গত পনেরো বছরে রেলের উন্নয়নের নামে সাত হাজার কোটি টাকার রোলিংস্টক ক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে। ইঞ্জিন, কোচ এবং যন্ত্রাংশ কেনাকাটায় গঠিত সিন্ডিকেট বহু কোটি টাকা লুটেপুটে নিয়েছে। সাবেক মন্ত্রী থেকে শুরু করে রেল মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই দুর্নীতি কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে তদন্তে প্রমাণ মিলেছে। দুর্নীতির কারণে কেনা ইঞ্জিন ও রোলিংস্টকের কার্যকারিতা সংকটে পড়েছে, যার ফলে দেশের রেল যোগাযোগ ও যাত্রী সেবা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুদকের তদন্তে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০০০ কোটি টাকা খরচ হয় রেলের উন্নয়নের নামে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় ৯৬টি ইঞ্জিন কেনার জন্য। কিন্তু এসব ইঞ্জিনের বেশিরভাগই ত্রুটিপূর্ণ এবং নিম্নমানের, যার ফলে ইঞ্জিনগুলোর গড় গতি মাত্র ৬৭ কিলোমিটার, যা আগের ইঞ্জিনগুলোর তুলনায় অর্ধেকেরও কম। দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানি থেকে কেনা ইঞ্জিনগুলোর ৬০-৭০ শতাংশ এখন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রাখা হয়েছে। এই দুর্নীতির জন্য সাবেক তিন রেলপথমন্ত্রীসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যদিও অনেকেই এখনও পলাতক।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম বলেন, “দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, দুদকের সহযোগিতাও করছি। তবে ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের কারণে ট্রেন পরিচালনায় সমস্যা বেড়েছে, মেরামতের খরচও বাড়ছে।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, “উন্নয়নের নামে যদি লুটপাট হয়, তাহলে সে উন্নয়ন থেকে প্রত্যাশিত সেবা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন। রেলের ইঞ্জিন ও কোচ হচ্ছে রেলের রক্ষাকবচ। সেখানে লুটপাট মানে সারা সিস্টেমটাই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। দুর্নীতিবাজরা বিদেশ সফর ও ভ্রমণের আড়ালে প্রকল্পের কাজ ব্যাহত করে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।”
অর্থনীতি বিশ্লেষক মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম মন্তব্য করেন, “রেলের উন্নয়ন প্রকল্পে বাজেটের বৃহৎ অংশ লোপাট হওয়ায় দেশের ট্রান্সপোর্ট খাতের গতি স্তব্ধ হচ্ছে। এই ধরনের দুর্নীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্তরায় সৃষ্টি করে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করে।”
সাবেক রেলওয়ে পরিচালক এ কে এম শফিউল ইসলাম বলেন, “ইঞ্জিন এবং কোচ কেনাকাটায় ব্যবহৃত অর্থ যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হত, তাহলে দেশের রেল যোগাযোগ আজ অনেক উন্নত অবস্থায় থাকত। ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ ও কম মানের ইঞ্জিনের কারণে রেল সেবা এখন ঝুঁকিপূর্ণ। যাত্রী নিরাপত্তা ও সেবায় এ ধরনের অনিয়ম মানা যায় না।”
আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার রোজিনা হক বলেন, “দুদক এবং অন্যান্য তদন্ত সংস্থাগুলোকে এই দুর্নীতির মূল নেটওয়ার্ক চিহ্নিত করে দ্রুত ও কার্যকর বিচার প্রক্রিয়া চালাতে হবে। দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সময়ের দাবি।”
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান বলেন, “ইঞ্জিনের ঘাটতি ও ত্রুটির কারণে অনেক রুটে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। নতুন ইঞ্জিন কেনাকাটায় দুর্নীতি ঠেকানো না গেলে রেল যোগাযোগের সংকট আরও বাড়বে।”
অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিংস্টক) আহমেদ মাহবুব চৌধুরী বলেন, “ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের বরাদ্দও নেই, ফলে সমস্যা বাড়ছে এবং যাত্রী সেবা প্রভাবিত হচ্ছে।”
রেলের উন্নয়নের নামে সংঘটিত এই বৃহৎ দুর্নীতির প্রভাব সরাসরি দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থায় পড়েছে। যাত্রী সেবার মান কমে যাওয়া, নিরাপত্তার হ্রাস এবং নির্ধারিত সময়সূচির ব্যাহত হওয়া এর প্রত্যক্ষ ফলাফল। সংশ্লিষ্ট সরকারী সংস্থা ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে অবিলম্বে এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে, স্বচ্ছ ও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করে ভবিষ্যতে এমন দুর্নীতি প্রতিরোধের তৎপরতা বাড়ানো অপরিহার্য। দেশের রেল যোগাযোগকে নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও আধুনিক করে তোলাই এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ