
ছবি: সংগৃহীত
ভারত সরকার হঠাৎ করেই বাংলাদেশ থেকে ৯ ধরনের পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা দুই দেশের বিদ্যমান বাণিজ্যিক সম্পর্ককে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। শুক্রবার (২৭ জুন) ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (DGFT) এর পক্ষ থেকে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমান্তবর্তী স্থলবন্দর দিয়ে এসব পণ্য ভারত আর আমদানি করবে না। তবে বিকল্প হিসেবে মহারাষ্ট্রের নভোসেবা সমুদ্রবন্দর দিয়ে এসব পণ্য আমদানির সুযোগ অব্যাহত থাকবে।
ভারতের এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছে বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত গুরুত্বপূর্ণ ৯টি পণ্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
কাঁচা পাট
পাটের রোল
পাটের সুতা
বিশেষ ধরনের কাপড়
এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ থেকে পাটভিত্তিক পণ্য ও কিছু বিশেষ বস্ত্রজাত পণ্য ভারতের ভোক্তা বাজারে ঢুকতে পারবে না স্থলপথে, যা পূর্বে সবচেয়ে সহজ ও দ্রুততম রুট ছিল।
এটি ভারতের তরফ থেকে প্রথম কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়। এর আগেই চলতি বছরের মে মাসে ভারত বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানিতে স্থলবন্দর ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তখন শুধুমাত্র কলকাতা ও নভোসেবা বন্দর দিয়ে এই পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। তৈরি পোশাক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত এবং ভারত এ খাতে বাংলাদেশের প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে থাকে। ফলে আগের নিষেধাজ্ঞায় তৈরি পোশাক খাতেই বড় ধাক্কা লাগে বলে বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠন জানিয়েছিল।
ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদফতর জানিয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র ভারত-গামী পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ, বাংলাদেশ থেকে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে একটি শর্ত রয়েছে: ওই পণ্যগুলো পুনরায় রপ্তানি করা যাবে না। অর্থাৎ, বাংলাদেশ থেকে ভারতের হয়ে ভুটান বা নেপালে কিছু পাঠিয়ে পরে তা আবার অন্য দেশে রপ্তানির কোনো সুযোগ থাকবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের এমন একতরফা নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য একাধিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়তে পারে পাটখাত এবং তৈরি পোশাক খাতে। স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন ব্যয় ও সময় বাঁচায়, যা সমুদ্রপথে তুলনামূলক ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এখন এইসব পণ্য শুধুমাত্র নভোসেবা সমুদ্রবন্দর দিয়ে পাঠাতে হলে পরিবহন খরচ বাড়বে এবং ছোট ও মাঝারি রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা কঠিন হবে।
বিশেষত কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা একটি উদ্বেগজনক বিষয়, কারণ বাংলাদেশ বহু বছর ধরে ভারতের পাটশিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ করে আসছে। এখন ভারত যদি নিজস্ব উৎপাদন বা বিকল্প উৎসে চলে যায়, তবে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদে পাট রপ্তানি বাজার সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
ভারতের এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র বাণিজ্যিক নয়, বরং কূটনৈতিক বার্তা বহন করছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক কিছু টানাপোড়েন ও আঞ্চলিক বাণিজ্য নীতির অংশ হিসেবেই এটি দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে নন-টারিফ ব্যারিয়ার (অশুল্ক বাধা) এর মাধ্যমে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশ ঠেকানো ভারতীয় কৌশলের অংশ হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যার বড় একটি অংশ স্থলবন্দর দিয়ে পরিচালিত হয়। এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা শুধু তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, দীর্ঘমেয়াদে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক আস্থা ও সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং ব্যবসায়িক সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। তবে এখন পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে বাণিজ্য সহজীকরণ ও প্রতিবেশী সম্পর্ক মজবুত করতে হলে এ ধরনের একতরফা নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ