
ছবি: সংগৃহীত
বৈশ্বিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, রপ্তানি সংকট এবং জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার জোড়া চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি সামনে এক কঠিন সময় পার করতে যাচ্ছে—এমনটিই উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (IMF) সর্বশেষ মূল্যায়নে। আইএমএফের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ঋণ ছাড়ের অংশ হিসেবে প্রকাশিত বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) রাতে প্রকাশিত বিস্তারিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ ঝুঁকি, সম্ভাবনা এবং নীতিগত সংস্কার পরিকল্পনার সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।
বহুমুখী চ্যালেঞ্জে জর্জরিত অর্থনীতি
আইএমএফের রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এখন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক—দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগোতে হবে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তি শুল্ক আরোপের কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কা রয়েছে, অন্যদিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্য সংকটের অভিঘাত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। এই কারণে প্রবৃদ্ধি হারেও প্রত্যাশা অনুযায়ী গতি আসেনি।
অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে স্থবিরতা, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, কম রাজস্ব আয় এবং বাজেট বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা। ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কমে যাওয়ায় পুঁজির জোগান যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি উৎপাদন খাতেও গতি আসছে না।
রপ্তানির ওপর শুল্ক ও আমদানি খরচে বাড়তি চাপ
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানিতে ট্রাম্প প্রশাসনের বাড়তি শুল্ক আরোপের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাত, যা একা রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৬ শতাংশ এবং কর্মসংস্থানের বড় উৎস। এর মধ্যে ৫৪ শতাংশ পোশাক রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। অতএব, মার্কিন বাজারে বাধা তৈরি হলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে বড়সড় ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে, বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার পূর্বাভাসও দিয়েছে আইএমএফ। এর ফলে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক লেনদেন ঘাটতি জিডিপির ৩.৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও আগামী বছর তা বেড়ে ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
রেমিট্যান্স ও জ্বালানি খাতে ঝুঁকি
মধ্যপ্রাচ্য এখনো বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের সবচেয়ে বড় উৎস। সেই অঞ্চলে অস্থিরতা বেড়ে গেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ হঠাৎ কমে আসতে পারে, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হবে। একইসঙ্গে, মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের প্রভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ দেশ এখনো নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতে সক্ষম হয়নি। জ্বালানির ঘাটতির কারণে উৎপাদন ও বিনিয়োগ উভয়েই ব্যাহত হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের রেশ এখনো কাটেনি
রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ও জ্বালানি তেলের দামে হঠাৎ বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। সেই প্রভাব এখনো কাটেনি। এমন পরিস্থিতিতে আরও কোনো বৈশ্বিক সংকট বা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনীতিকে আরও ভঙ্গুর করে তুলবে।
আইএমএফের সংস্কার রোডম্যাপ
এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আইএমএফ বেশ কিছু কাঠামোগত সংস্কারের সুপারিশ করেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সময়সীমাও নির্ধারণ করেছে। নিচে তা পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হলো:
জ্বালানি খাতে
আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটি তিন বছর মেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
ভর্তুকি পর্যায়ক্রমে কমিয়ে শূন্যে নামাতে হবে, যাতে বাজেটের ওপর চাপ কমে।
জ্বালানি সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করতে হবে—যাতে উৎপাদন খাত আস্থা ফিরে পায় এবং বিনিয়োগে উৎসাহ পায়।
রাজস্ব খাতে
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) জুনের মধ্যে গভীর সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
করদাতাদের জন্য ই-রিটার্ন পদ্ধতি চালু করতে হবে।
ডিসেম্বরের মধ্যে উন্নত করসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
আগামী বছরের মার্চের মধ্যে সব ধরনের কর ছাড় বন্ধ করতে হবে।
সরকারি আর্থিক লেনদেন
জুনের মধ্যে সরকারি লেনদেনের অন্তত ৫০ শতাংশ অনলাইনে আনতে হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বকেয়া ঋণ ও দায়দেনা পরিশোধ নিশ্চিত করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ঋণ শ্রেণিবিন্যাস বেসরকারি খাতের মতো করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা
ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
বিনিময় হারের বিষয়ে সিদ্ধান্তের একক ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে দিতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো হস্তক্ষেপ এখানে চলবে না।
আগামী জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বতন্ত্রভাবে মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে।
বহুমুখীকরণ ও রপ্তানিনির্ভরতা কমাতে পরামর্শ
পোশাক খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আইএমএফ রপ্তানি বহুমুখীকরণের সুপারিশ করেছে। কৃষি, চামড়া, ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তিসহ অন্যান্য খাতে রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে বলেছে সংস্থাটি।
একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদাও কমবে।
আইএমএফের এই বিশ্লেষণ শুধু একটি ঋণের মূল্যায়ন নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে এগোচ্ছে এবং কোথায় কোথায় দুর্বলতা রয়েছে, তার একটি বিস্তারিত রূপরেখা। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হলে সরকারকে এখনই কঠোর সংস্কার, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং দূরদর্শী নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। নয়তো আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপে অর্থনীতি আরও সংকটের দিকে এগোতে পারে—যার পরিণতি বহুমাত্রিক।
বাংলাবার্তা/এমএইচ