
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে চলমান সংকট এবং অর্থনীতির সার্বিক মন্থর গতি এবার নতুন করে প্রভাব ফেলেছে আন্তঃব্যাংক লেনদেন ব্যবস্থায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে—চলতি বছরের জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে আন্তঃব্যাংক লেনদেন কমেছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। এই বিশাল পতন শুধু ব্যাংকিং খাত নয়, পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্যই একটি উদ্বেগজনক বার্তা বহন করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারিতে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৬০ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। আর ফেব্রুয়ারিতে সেই পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৬১৫ কোটি টাকায়। এতে দেখা যাচ্ছে, মাত্র এক মাসে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৯ কোটি টাকার লেনদেনের ফাঁক তৈরি হয়েছে, যা কোনো অর্থনীতির জন্যই হালকা সংকেত নয়।
তবে পরিস্থিতি পুরোপুরি নেতিবাচক নয়। গত বছরের একই সময় অর্থাৎ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির তুলনায় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আন্তঃব্যাংক লেনদেন বেড়েছে ৪৪ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেনদেন ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ২১৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, চলমান অর্থনৈতিক স্থবিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, আমদানি নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে ভাটা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং খাতে। বিশেষ করে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অনেক উদ্যোক্তা এখন বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকছেন।
বিনিয়োগ না বাড়লে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের চাহিদা কমে যায়। একই সঙ্গে লেনদেনও সংকুচিত হয়। যে কারণে আন্তঃব্যাংক লেনদেন কমে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ইঙ্গিত মিলেছে, সরকারপ্রধান দল আওয়ামী লীগ আমলে সংঘটিত নানা আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে দেশের একাধিক ব্যাংক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে প্রায় ১১টি ব্যাংক চরম লুটপাট, ঋণ অনিয়ম এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে।
এই দুর্বল ব্যাংকগুলো এখন আন্তঃব্যাংক থেকে অর্থ ধার নিয়েও তা সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে অন্যান্য ব্যাংকগুলো তাদের সঙ্গে লেনদেনে আগ্রহ হারাচ্ছে। এতে আন্তঃব্যাংক ট্রেডিং বা আর্থিক আদান-প্রদানের আকার সংকুচিত হয়ে আসছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা কমে গেলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি থেমে যায়। কারণ, আন্তঃব্যাংক লেনদেন বাড়া মানেই বাজারে তারল্য প্রবাহ সচল থাকা এবং বিনিয়োগের পরিবেশ ভালো থাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের শেষ তিন মাসেও লেনদেনে ওঠানামা ছিল চোখে পড়ার মতো।
২০২৪ সালের নভেম্বরে লেনদেন হয়েছিল ৬ লাখ ৫২ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা।
ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ২৯ হাজার ৮০ কোটি টাকায়।
জানুয়ারিতে আবার তা বেড়ে পৌঁছায় ৭ লাখ ৬০ হাজার ৭১৪ কোটিতে।
অর্থাৎ নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত লেনদেন বেড়েছিল ৭৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। এরপর জানুয়ারিতে আবারও ৩১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা লেনদেন বেড়েছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে আচমকা ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৯ কোটির পতন আবারও নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।
আর্থিক খাত বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাসুদ রানা বলেন, “এই ধরণের পতন শুধু তারল্য সংকটের প্রতিফলন নয়, বরং বৃহৎ অর্থনীতিতে আস্থাহীনতার প্রকাশ। ব্যাংকগুলো যখন পারস্পরিক লেনদেনে সঙ্কুচিত হয়, তখন বোঝা যায় তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “যে ১১টি ব্যাংকের কথা বলা হচ্ছে, তাদের মধ্যে কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও রয়েছে। এই ব্যাংকগুলোতেই বিগত এক দশকে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি, খেলাপি ঋণ এবং অব্যবস্থাপনার ইতিহাস রয়েছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এই লেনদেন হ্রাসের কারণ ব্যাখ্যা না দিলেও বিশেষজ্ঞ মহল বলছে, এখনই সময় ব্যাংক খাতে ব্যাপক সংস্কার আনার। প্রয়োজন খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, সুশাসন নিশ্চিতকরণ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধ এবং ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা পুনরুদ্ধারে শক্তিশালী নীতিমালা বাস্তবায়ন।
অন্যথায়, শুধু আন্তঃব্যাংক লেনদেন নয়—এর প্রভাব পড়বে শেয়ারবাজার, বিনিয়োগ, আমদানি-রপ্তানি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর।
অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে যখন চাপ বাড়ছে, তখন আন্তঃব্যাংক লেনদেনে এই লাখ কোটির পতন নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়। শুধুমাত্র অস্থায়ী কারণ নয়, বরং গভীরে রয়েছে আর্থিক শৃঙ্খলার অভাব, আস্থার সংকট এবং দুর্নীতির ইতিহাস। এই বাস্তবতা থেকে বের হয়ে আসতে হলে এখনই প্রয়োজন কঠোর আর্থিক সংস্কার ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
যদি তা না হয়, তাহলে সামনে আরও বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং পুরো অর্থনীতি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ