
ছবি: সংগৃহীত
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর দশ মাস পার হলেও এখনো সরকার ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা করেনি—এমন অভিযোগে উত্তাল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ছাত্র ও যুব সমাজ। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবিকৃত এই সনদ নিয়ে সরকারের ‘গড়িমসি’ এবং ‘অস্বচ্ছ অবস্থান’ ঘিরে ক্রমেই তৈরি হচ্ছে নতুন আন্দোলনের ঢেউ। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি বিক্ষোভ মিছিল শেষে ছাত্র ও যুবদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম ‘জুলাই ঐক্য’ স্পষ্ট ভাষায় সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছে—অবিলম্বে জুলাই সনদ ঘোষণা করতে হবে, অন্যথায় দেশজুড়ে শুরু হবে কঠোর কর্মসূচি।
সমাবেশে ‘জুলাই ঐক্য’র অন্যতম মুখপাত্র মুসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ বলেন, “বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা আর কোনো বিদেশি দূতাবাসের সনদ বা প্রস্তাব গ্রহণ করবে না। এ বিষয়ে দ্রুত সরকারকে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। আমরা কোনো গোপন জোটের গোপন সনদ চাই না। আমরা চাই, স্পষ্ট করে জুলাই সনদের ঘোষণা দেওয়া হোক—এটাই জনগণের দাবি, চব্বিশের অভ্যুত্থানের মূল ভিত্তি।”
তিনি বলেন, “৭২ সালে একটি বিদেশিদের লেখা গল্পকে ‘সংবিধান’ বলে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই সংবিধান শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট শাসক বানিয়েছিল। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান সেই গণতন্ত্রহীনতাকে বাতিল করেছিল। কিন্তু এখন ১০ মাস পার হয়ে গেলেও জনগণের ম্যান্ডেট অনুযায়ী জুলাই সনদ হয়নি। সরকার বারবার ওয়াদা করে, আবার তা অস্বীকার করে। এই সনদ কোথা থেকে লেখা হচ্ছে, কে লেখে—সরকারকে তা জানাতে হবে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবি জুবায়ের বলেন, “আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে চারটি মৌলিক দাবি জানিয়েছিলাম—গণহত্যার বিচার, জুলাইয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, শহীদ ও আহতদের পুনর্বাসন এবং একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। যেন তারা সময় নষ্ট করছে, প্রক্রিয়া নয়।”
তিনি আরও বলেন, “ভারতের আধিপত্যবাদ ও সীমান্তে অবৈধ পুশইন নিয়ে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার এখনো কার্যকর কোনো অবস্থান নেয়নি। চব্বিশের শহীদদের স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরিবর্তে সুশীলতার নামে সময়ক্ষেপণ করছে। জনগণ চুপ করে থাকবে না। ইন্টেরিম সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া হবে না।”
বিক্ষোভ শেষে ঘোষিত কর্মসূচিতে বলা হয়েছে—আগামী চার দিন সারা দেশে জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গণসংযোগ চলবে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে আলোচনা, লিফলেট বিতরণ এবং পথসভা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ১ জুলাই (পহেলা জুলাই) রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ‘ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ অনুষ্ঠিত হবে।
মুসাদ্দেক আলী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “এই আন্দোলন আপসহীন। আমাদের দাবি পরিষ্কার—একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের জন্য যে জুলাই সনদের ম্যান্ডেট ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে জনগণ দিয়েছিল, সেই সনদ দ্রুত ঘোষণা করতে হবে। তা না হলে নতুন আন্দোলনের আগুন আর কেউ থামাতে পারবে না।”
সরকারের বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন বা নতুন কাঠামো তৈরির কথা’ বলা হলেও, ‘জুলাই ঐক্য’ স্পষ্ট করে জানিয়েছে, বাইরের কোনো চাপ বা সহায়তা নয়, বাংলাদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যতের কাঠামো নির্ধারণ করবে।
এ বিষয়ে এবি জুবায়ের বলেন, “আমরা কোনও ‘ডনোর ড্রাফট’ চাই না। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সংগ্রাম থেকে বেরিয়ে আসা চব্বিশের চেতনার ভিত্তিতেই তৈরি হতে হবে নতুন সনদ। কোনো দূতাবাস বা আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদের পরিচয় লিখে দেবে না।”
জুলাই ঐক্যের নেতারা মনে করছেন, এখনো সময় আছে—সরকার চাইলে জনগণের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় বসতে পারে এবং পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রকাশ করতে পারে। না হলে পরিস্থিতি আবারো উত্তাল হয়ে উঠবে বলে সতর্ক করেছেন আন্দোলনকারীরা।
জুলাই ঐক্যের নেত্রী প্লাবন তারিক বলেন, “সরকার এখনো চুপচাপ থেকে জনগণের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছে—এই জনগণই এক যুগের স্বৈরাচার ভেঙেছে। এবারও থামবে না।”
সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠক ইসরাফিল ফরাজী, মাকসুদ রহমানসহ ছাত্র, যুব ও শ্রমজীবী শ্রেণির শতাধিক কর্মী।
‘জুলাই সনদ’ এখন আর কেবল একটি রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠনের দাবি নয়, বরং এটি পরিণত হয়েছে একটি প্রজন্মের প্রতিনিধি চেতনায়। যারা বিশ্বাস করে, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান শুধু শাসকের পতন নয়, বরং নতুন রাষ্ট্র কাঠামো নির্মাণের ডাক। সেই কাঠামোর ভিত্তিপ্রস্তরই হবে—জুলাই সনদ।
এই প্রেক্ষাপটে সরকার যদি জনগণের দাবিকে অগ্রাহ্য করে, তাহলে সামনে নতুন এক গণজোয়ারের মুখোমুখি হতে পারে পুরো রাষ্ট্র।
বাংলাবার্তা/এমএইচ