
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিনকার যানজটের যে দুর্ভোগ, তার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কতটা ভয়াবহ হতে পারে— সেটির একটি খোলামেলা চিত্র তুলে ধরলেন প্রধান উপদেষ্টার রোড, ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ব্রিজ-বিষয়ক বিশেষ সহকারী ড. শেখ মইনুদ্দিন।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) রাজধানীর বনানীতে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তব্য রাখেন তিনি। এতে তিনি বলেন, ঢাকার যানজটের কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, যা দিয়ে দুটি করে অত্যাধুনিক এমআরটি (মেট্রোরেল) লাইন নির্মাণ করা সম্ভব হতো। এছাড়া বছরে মানুষের সময় নষ্ট হচ্ছে প্রায় ৫ মিলিয়ন ঘণ্টা, যা অর্থনীতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
সেমিনারের আয়োজন ছিল মূলত পিআরআই-এর মাসিক ম্যাক্রোইকোনমিক ইনসাইটস (এমএমআই) প্রকাশ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পরবর্তী বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে। এতে সভাপতিত্ব করেন পিআরআই চেয়ারম্যান ও খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. জাইদী সাত্তার। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তিনিই এবং তার সঙ্গে ছিলেন পিআরআইয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান। আলোচনায় আরও অংশ নেন বিল্ডের (বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট) চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ফেরদৌস আরা বেগম এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. শেখ মইনুদ্দিন বলেন, “ঢাকায় যানজট এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে মানুষের সময় ও সম্পদ একসঙ্গে অপচয় হচ্ছে। কিন্তু এই সমস্যার জন্য দায়ী কেবল সড়কের চাপ নয়, বরং নগর পরিকল্পনা ও অবকাঠামো ব্যবস্থাপনায় অভাব রয়েছে একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির।”
তিনি বলেন, “আমরা যদি একটিবার চিন্তা করি, কীভাবে এই ৩৭ হাজার কোটি টাকা প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে, তাহলে বোঝা যায়, শুধু ভোগান্তি নয়, এটি একটি জাতীয় ক্ষতির বিষয়।”
ড. মইনুদ্দিন আরও বলেন, “আমরা যখন একটি অবকাঠামো নির্মাণ করি, তখন পরিকল্পনা, ডিজাইন এবং বাস্তবায়নের মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় থাকে না। আমরা সড়ক মেরামত করি, তারপর দেখি ওই জায়গায় পানি বা গ্যাস লাইনের কাজ শুরু হয়। ফলে আবার ভাঙা, আবার মেরামত— এই চক্র চলছে।”
তিনি বলেন, “এই চিত্র কেবল সড়ক খাতে নয়— রেল, নৌ, বিমান এবং সড়ক পরিবহন— এই চারটি খাতে চারটি ভিন্ন মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে কাজ করছে। কিন্তু এই খাতগুলো যদি একটি ‘ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেটেড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি’র অধীনে একত্রে পরিচালিত হতো, তাহলে এর ফলাফল অনেক বেশি কার্যকর হতো।”
সরকারি প্রকল্পের বিলম্ব নিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের দেশে দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনেক সময় চলে যায়। আবার ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুমোদন পেতেই লেগে যায় ৪-৫ বছর। এই সময়ের মধ্যে টাকার মূল্যমান বদলায়, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ে, ফলে প্রকল্পের বাজেটও দ্বিগুণ হয়ে যায়। অথচ এই বিলম্ব এড়ানো যেত একটি দক্ষ এবং দ্রুতগতির সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।”
তিনি বলেন, “এখন সময় এসেছে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিবহন অবকাঠামো মাস্টারপ্ল্যান তৈরির। যেখানে সব খাত একসঙ্গে নিয়ে নির্দিষ্ট টাইমলাইন ও বাজেট ধরে অগ্রসর হওয়া যাবে। নাহলে আগামী পাঁচ বা দশ বছরে ঢাকায় বসবাসযোগ্যতা প্রায় হারিয়ে যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও যদি আমরা সঠিক পরিকল্পনা করি, তাহলে নগর উন্নয়নে সুফল আসবে। এমআরটি, বিআরটি কিংবা এক্সপ্রেসওয়ের মতো প্রকল্পগুলো বিচ্ছিন্নভাবে না করে একটি গ্র্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন ভিশনের অংশ হতে হবে।”
সেমিনারে পিআরআই চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার বলেন, “ঢাকার সমস্যা নিয়ে আমরা বহুদিন ধরেই বলছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যেকোনো নীতিনির্ধারণ বা বাজেট পরিকল্পনায় পরিবহন খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আর তাতেই দীর্ঘ মেয়াদে দেশকে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।”
পিআরআই’র মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, “অর্থনীতি গতি পায় তখনই, যখন মানুষ কর্মস্থলে দ্রুত পৌঁছাতে পারে, পণ্য সহজে পরিবহণ হয়, এবং বিনিয়োগকারীরা সময়মতো মালামাল পাচ্ছে। যানজট সেই কাঠামোকে পুরোপুরি ব্যাহত করছে।”
প্যানেল আলোচক ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, “ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পরিবহণ ব্যবস্থার অদক্ষতা একটি বড় বাধা। আন্তর্জাতিক লগ্নিকারীদের কাছেও এটি নেতিবাচক বার্তা পাঠায়।”
রিজওয়ান রহমান বলেন, “প্রতিদিন অফিসে যেতে যেখানে ৩০ মিনিট লাগার কথা, সেখানে এখন ২ ঘণ্টা সময় লাগছে। এই সময় ও শ্রমের অপচয় আমাদের জাতীয় উৎপাদনশীলতাকে সরাসরি আঘাত করছে।”
সেমিনারে বক্তারা একমত হন যে, টেকসই নগরায়ণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য পরিবহন ব্যবস্থায় অবিলম্বে বিপ্লবী সংস্কার প্রয়োজন। বিশেষ করে, ‘এক মন্ত্রণালয় এক উদ্যোগ’ এড়িয়ে একটি সুসংহত অবকাঠামো কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যার অংশ হতে হবে জাতীয়, মহানগর ও স্থানীয় প্রশাসন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর বক্তব্যে স্পষ্ট যে, ঢাকার যানজট শুধু একটি নাগরিক সমস্যা নয়, বরং এটি একটি জাতীয় অর্থনৈতিক সংকটের রূপ নিয়েছে। সমন্বিত পরিবহন নীতি ও দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া চালু না করলে এই ক্ষতি আগামীতে বহুগুণে বাড়বে। এখন সময়— এককথায়, কর্মপরিকল্পনায় একতা আনার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ