
ফাইল ছবি
২০০০ সালের ২৬ জুন—বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনেই মেলেছিল সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতির দরজা, যেটা প্রতিটি ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের স্বপ্ন। আইসিসি বাংলাদেশকে টেস্ট মর্যাদা দেয়, ক্রিকেটের অভিজাত পরিমণ্ডলে জায়গা করে নেয় লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। সময়টা এখন ২০২৫ সাল, অর্থাৎ কেটে গেছে টেস্ট খেলার ২৫ বছর—রজত জয়ন্তী।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সেই দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে আয়োজন করছে নানা অনুষ্ঠানের। হচ্ছে স্মরণিকা প্রকাশ, বিশেষ টকশো, প্রাক্তন-বর্তমান খেলোয়াড়দের মিলনমেলা। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই ২৫ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ সত্যিই কী অর্জন করেছে? শুধু আনুষ্ঠানিকতা, আতশবাজি, ফুলের তোড়া আর করতালিতেই কি ঢাকা যাবে দীর্ঘদিনের হতাশা? নাকি সময় এসেছে এক নির্মম আত্মসমালোচনার?
সময়ের বিচারে ২৫ বছর কম নয়। এই সময়েই একটা প্রজন্ম বেড়ে ওঠে, একটা দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তি অর্জন করে, একটা প্রতিষ্ঠান মহীরূহ হয়ে ওঠে। অথচ এই দীর্ঘ সময় পরও বাংলাদেশের টেস্ট দলের অবস্থা যেন দোলাচলে থাকা এক অপূর্ণ দল।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত মোট ১৫৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে, যার মধ্যে জিতেছে মাত্র ২৩টি, ড্র করেছে ১৯টি এবং পরাজয়ের সংখ্যা ১১১টি। মানে প্রতি বছর একটা করে জয়ও গড়েনি দলটি! এমন পরিসংখ্যান একটি নবীন দলের শুরুতে কিছুটা সহনীয় হলেও, একচতুর্থাংশ শতাব্দীর মাথায় দাঁড়িয়ে এটি লজ্জার। আফগানিস্তানের কথা ভাবুন—মাত্র দেড় দশক আগেও যারা ছিল আইসিসির অ্যাসোসিয়েট সদস্য, এখন তারা বিশ্বকাপের সেমিফাইনালিস্ট।
টেস্ট ক্রিকেট মানেই লম্বা ইনিংস, ধৈর্য, একাগ্রতা আর মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। অথচ সেই জায়গায় ব্যর্থতার পরিচয় বারবার দিয়েছে বাংলাদেশ। পুরো ২৫ বছরে মাত্র ৫টি ডাবল সেঞ্চুরি, একটি ট্রিপল সেঞ্চুরিও নেই। এমনকি মুশফিকুর রহিম ব্যতীত আর কেউ টেস্টে ৩০০ বল খেলার ধৈর্য দেখাতে পারেননি একাধিকবার।
এই ধরনের ব্যাটিং ব্যর্থতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি এক অব্যাহত প্রবণতা। গল টেস্টে মুশফিক আবারও ৩০০ বল খেলার বিরল নজির গড়লেও, অন্যদিকে এনামুল হক বিজয়ের মতো ঘরোয়া তারকা আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিন ইনিংসে করেছেন মাত্র ৪ রান। দুই ইনিংসে তিনি রানের খাতাও খুলতে পারেননি।
এ থেকে স্পষ্ট—দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্স আন্তর্জাতিক মঞ্চে অনুবাদ হচ্ছে না। কারণ সেখানে বোলিংয়ের মান এমন, যেখানে প্রতি ওভারে একটা করে বাজে বল পাওয়া যায়, যা দিয়ে সেঞ্চুরি সহজ হয়ে ওঠে। অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেই সুযোগ নেই।
ঘরোয়া ক্রিকেটের মানোন্নয়নে বিসিবির ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। অথচ গত ২৫ বছরে ঘরোয়া ক্রিকেটে কাঠামোগত কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়নি।
সাকিব আল হাসান প্রায় দুই দশক আগেই বলেছিলেন, ‘‘দেশে ৩ ঘণ্টা দাঁড়ালে সেঞ্চুরি পাওয়া যায়, বাইরের দেশে সেটা পেতে লাগে ৫ ঘণ্টা, আর বাজে বলের জন্য অনেক বেশি অপেক্ষা করতে হয়।’’ এত বছর পরও সাকিবের সেই বক্তব্য আজও বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে।
এর দায় কার? নিশ্চয়ই শুধু ক্রিকেটারদের নয়, বিসিবিও ব্যর্থ হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মান অনুযায়ী প্রস্তুতি দেওয়ার মতো প্রতিযোগিতা গড়ে তুলতে।
সফল ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোয় একটা সুসংগঠিত ‘ক্রিকেট সংস্কৃতি’ থাকে। যেখানে খেলোয়াড়দের রয়েছে আর্থিক নিরাপত্তা, চোট পেলে পুনর্বাসনের সুব্যবস্থা, পারফর্ম করলে জাতীয় দলে সুযোগের নিশ্চয়তা, নির্বাচনে স্বচ্ছতা এবং সুনির্দিষ্ট উপায়—এইসবই ক্রিকেটারদের মানসিকভাবে তৈরি হতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে এই কাঠামো এখনো অনুপস্থিত। বহু প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেটার প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছেন হয় চোটে, নয়তো নির্বাচনী অব্যবস্থাপনায়। বারবার দেখা যায়, ঘরোয়া পারফর্মারদের দলে নেওয়া হয় তাড়াহুড়ো করে, আবার বাদও দেওয়া হয় সেই রকমভাবে।
বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদার ২৫ বছর পূর্তিকে ঘিরে যেমন আয়োজন হচ্ছে, তেমন যদি পরিকল্পনা ও পরিশ্রম হতো মাঠে—তবে চিত্রটা হতো ভিন্ন। বাস্তবতা হলো, এই দীর্ঘ পথচলায় কেবল সাময়িক কিছু সাফল্য ছাড়া বড় কোনো অর্জন নেই।
জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কিংবা অস্ট্রেলিয়াকে এক-আধবার হারানো ছাড়া এমন কোনো ধারাবাহিকতা নেই যা দেখে বলা যায়—বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে পরিণত দল।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ২৬ জুন একটি গর্বের দিন বটে, তবে এটাকে কেবল আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে স্মরণ করলে চলবে না। এই দিন হোক উপলক্ষ, এক নির্মম আত্মসমালোচনার। বিশ্লেষণ হোক বিসিবির নীতিনির্ধারকদের, খেলোয়াড়দের, কোচিং স্টাফদের ব্যর্থতার।
টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতির জন্য চাই ঘরোয়া ক্রিকেটে কাঠামোগত সংস্কার, খেলোয়াড়দের মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতির উন্নয়ন, ক্রিকেট সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা এবং স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া।
২৫ বছর তো কেটে গেল, যদি এখনো না জাগে বিসিবি, তাহলে হয়তো পরের ২৫ বছরও একই চিত্র নিয়ে আলোচনা করতে হবে—শুধু পরিসংখ্যান আর সম্ভাবনার খরচায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ