
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘদিন ধরেই বীমা খাতে শৃঙ্খলার অভাব, পলিসিধারীদের পাওনা দাবির বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকা, দুর্বল কোম্পানিগুলোর অনৈতিক কার্যক্রম এবং পরিচালকদের পলাতক থাকা—এই সংকট নিরসনের পথে প্রথম বড় পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার। ব্যাংকের মতো এখন বীমা কোম্পানির ক্ষেত্রেও আসছে ‘রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’। এর আওতায় সরকার সমস্যাগ্রস্ত বীমা কোম্পানির সাময়িক মালিকানা নিতে পারবে, প্রয়োজনে তা একীভূত করবে অথবা তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেবে।
এই লক্ষ্যে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) ইতোমধ্যে ‘বীমাকারীর রেজল্যুশন অধ্যাদেশ-২০২৫’-এর খসড়া প্রস্তুত করেছে, যা ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের ছায়ায় তৈরি হলেও এতে আরও বিস্তৃত কিছু ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে খুব শিগগিরই অধ্যাদেশটি জারি হবে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে, এমন ইঙ্গিত মিলেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে।
আইডিআরএর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১৫টি জীবন বীমা কোম্পানিতে ১১ লাখেরও বেশি গ্রাহকের প্রায় ৪ হাজার ৬১৫ কোটি টাকার দাবি আটকে আছে। এর মধ্যে পরিশোধ হয়েছে মাত্র ৬৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার দাবিই রয়ে গেছে বকেয়া। এসব প্রতিষ্ঠানের একাংশের মালিকরা এখন পলাতক, আর কিছু প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর দাবি নিষ্পত্তি না করেও চালিয়ে যাচ্ছে কার্যক্রম।
এই ১৫টি কোম্পানির মধ্যে রয়েছে—সানফ্লাওয়ার লাইফ, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন, সানলাইফ, পদ্মা ইসলামী লাইফ, প্রগ্রেসিভ লাইফ, প্রটেক্টিভ ইসলামী লাইফ, বেস্ট লাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ, প্রাইম ইসলামী লাইফ, যমুনা লাইফ, ডায়মন্ড লাইফ, স্বদেশ লাইফ, গোল্ডেন লাইফ, বায়রা লাইফ এবং এনআরবি ইসলামিক লাইফ।
অধ্যাদেশে কী থাকছে?
খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে—
সরকার ও আইডিআরএ যে কোনো বীমা কোম্পানিকে অবসায়ন, একীভূতকরণ বা তৃতীয় পক্ষের কাছে সম্পূর্ণ বা আংশিক শেয়ার হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীসহ যেকোনো কর্মকর্তা অপসারণ করা যাবে।
সংকট নিরসনের লক্ষ্যে এক বা একাধিক ‘ব্রিজ কোম্পানি’ গঠন করা হবে, যেগুলোর মেয়াদ সাধারণত ২ বছর, সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে।
ব্রিজ কোম্পানি পরিচালনার জন্য একটি পর্ষদ ও প্রধান নির্বাহী নিয়োগ করা হবে। এই কোম্পানিগুলোর তহবিল গঠনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে অর্থায়ন নেওয়া হবে।
শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
আইডিআরএ এই ১৫টি কোম্পানির ২০২২–২০২৪ সালের নিরীক্ষা রিপোর্ট তৈরির লক্ষ্যে গত সপ্তাহে কয়েকটি অডিট ফার্ম নিয়োগ দিয়েছে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে নিরীক্ষা রিপোর্ট জমা দিতে হবে।
নিরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে—প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র উদঘাটন করা, এবং এরপর সেই ভিত্তিতে রেজল্যুশনের আওতায় কোনটি থাকবে এবং কোনটির বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা চূড়ান্ত করা।
নতুন অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহক সুরক্ষায় একটি আলাদা তহবিল গঠন করা হবে। এই তহবিল ব্যবহার করা যাবে দাবি পরিশোধে বা রেজল্যুশনের প্রয়োজনে। একই সঙ্গে গঠন করা হবে একটি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল, যা বীমা খাতে পদ্ধতিগত সংকট চিহ্নিত করে সমাধানে ভূমিকা রাখবে।
আইডিআরএর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "বীমা খাতে দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অদক্ষতা নিরসনে অধ্যাদেশটি হবে একটি মাইলফলক। প্রথমবারের মতো পলিসিধারীদের দাবির যথাযথ প্রতিকার নিশ্চিত করতে সরকার সক্রিয়ভাবে নীতি নির্ধারণে নামছে।"
অর্থনীতিবিদ ও বীমা খাত-সংক্রান্ত বিশ্লেষকদের মতে, এই অধ্যাদেশ বাস্তবায়িত হলে দুর্বল ও অনিয়মে জর্জরিত বীমা কোম্পানিগুলো হয় সরকারি মালিকানায় আসবে, নয়তো একীভূত হয়ে বড় প্রতিষ্ঠানের অংশ হয়ে যাবে। এতে বাজারে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, পলিসিধারীরা সময়মতো দাবি পাবেন এবং নতুন বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।
তবে তারা বলছেন, কার্যকর বাস্তবায়নই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ অতীতে বিভিন্ন কমিশন, অধ্যাদেশ ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা বহুবার দেখা গেছে।
এক সময়ের সম্ভাবনাময় বীমা খাত এখন পরিণত হয়েছে বিশৃঙ্খল এক উপখাতে, যেখানে গ্রাহকের টাকা আটকে থাকে বছরের পর বছর, অথচ কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। এই অবস্থায় রেজল্যুশন অধ্যাদেশ যদি সময়মতো ও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে বীমা খাতের প্রতি গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো সম্ভব হবে।
এখন দেখার বিষয়, অধ্যাদেশটি কত দ্রুত জারি হয় এবং আইডিআরএ তার প্রয়োগে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ